২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন

-

সাবিহা। বয়স বাইশ। ইউনিভার্সিটির অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। এতদিন মোটামুটি ভালোই ছিল। মানে মাসিকের সময় তলপেটে একটু ব্যথা কিংবা মাঝে মধ্যে শরীরটা একটু দুর্বল লাগা ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু মাস তিনেক যাবত সাহিবার নতুন কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাম স্তনের বোঁটা থেকে নিজে নিজেই হলুদ পানির মতো ঝরে। তেমন ব্যথা নেই। তবে আশপাশের চামড়ার রঙ তামাটে বর্ণ হয়ে গেছে। অনেক সময় এত বেশি পানির মতো ঝরে যে উপরের জামা ভিজে যায়। মাঝে মধ্যে স্তনের বোঁটা টন টন করে ব্যথা করে। গত ১০-১২ দিন যাবত হলুদ রঙের পানির সাথে একটু একটু রক্তবর্ণ পুঁজও আসা শুরু হয়েছে। সাবিহা অবিবাহিত মেয়ে। হলে থাকে। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারে না। ইদানীং আবার বাম বগলের নিচে দুটো চকালো গোল চাকার মতো কী যেন মনে হয়। স্তনের বোঁটার চামড়া অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। গত তিন-চার দিন ধরে এখানেও একটা শক্ত চাকার মতো হয়ে গেছে। একটু আঘাত লাগলে কিংবা কাপড়ের ঘষা লাগলে রক্ত পড়ে। আর কী চুপ করে রোগকে লুকানোর উপায় আছে। সাবিহা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। হায় আল্লাহ। এখন কী হবে? সাবিহা এমনিতেই লাজুক। পুরুষ ডাক্তারের কাছে মরে গেলেও যাবে না। মহিলা ডাক্তারের খোঁজে কোথায় যাবে? অবশেষে রুমমেটকে সব খুলে বলে। ইদানীং গায়ে জ্বরও আসে। খাবার রুচিও কম। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়তে শুরু করেছে। রুমমেট সব শোনার পর সেদিন দুপুরেই ওরা ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার বিস্তারিত জানার পর একটি সরকারি হাসপাতালের স্তন ক্লিনিক নামের একটি সেন্টারে তাড়াতাড়ি দেখা করতে বলেন। ডাক্তার যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে সাবিহার সমস্যাগুলো শোনেন এবং কিছুতেই যেন আর দেরি না করেন সেজন্য ভালোভাবে বোঝান। সাবিহা ভয়ে কেঁদে ফেলে। কেন এমনটি হলো? সাবিহার বাবা নেই। পড়ার খরচ বড় ভাইয়ের টাকায় চলে। এখন এই চিকিৎসার বাড়তি খরচের টাকা ভাইয়ের কাছে কিভাবে চাইবে? মনে মনে ঠিক করে স্কলারশিপের অল্প কিছু টাকা ব্যাংকে আছে প্রয়োজনে সেটা তুলবে। ব্রেস্ট ক্লিনিকে যাওয়ার পর সাবিহাকে যতœ করে দু’জন মহিলা ডাক্তার দেখলেন। আশ্বস্ত করলেন স্তনের বোঁটা থেকে নিঃসৃত রস পরীক্ষার জন্য পাঠালেন। স্তনে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করালেন। বায়োপসি নামের একটি পরীক্ষাও করালেন। সরকারি হাসপাতাল বলে টাকা বেশি খরচ হলো না। সাবিহাকে কিছু ওষুধপত্র লিখে দিলেন। এত তো দেরি করে আসা যে কোনো মতেই উচিত হয়নি সেটি বারবার ঘুরেফিরে ডাক্তার বললেন। তবে যেকোনো অবস্থাতেই হোক না কেন সাবিহাকে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবেÑ ডাক্তার একরকম ওয়াদা করালেন। প্রয়োজনে বিনা টাকায় কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন রক্তের কিছু পরীক্ষা কিডনি এবং লিভারের কিছু পরীক্ষা তিনি ফ্রি লিখে দিলেন। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে সাবিহার কান্না পাচ্ছে। কেন এমনটি হলো? রিপোর্ট নিতে আবার পরের দিন আসতে হবে। বায়োপসির রিপোর্ট দিতে তিন দিন সময় লাগবে, ডাক্তার বারবার বলেছেন অবহেলা করার কোনো সুযোগও নেই। সাবিহা এখন কী করবে? সেদিন বায়োপসির রিপোর্ট ডাক্তার দেখলেন বললেন, সাবিহার গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে। স্তনে ক্যান্সার ভালোভাবে বাসা বেঁধেছে, অপারেশন লাগবে এবং অপারেশনের আগেই কিছু ওষুধ ইনজেকশন নিতে হবে। এত কথা তো আর সাবিহাকে বলা যায় না। রুমমেটকে ডাক্তার কিছুটা খুলে বললেন এবং বাড়ির লোকদের যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি খবর দিতে বললেন। কিন্তু ডাক্তারের আচরণে সাবিহা কিছুটা বুঝে ফেলে যে, তার রোগটি ক্যান্সার হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। তবে মনোবল হারালে চলবে না। সাবিহা চোখের পানি মোছে এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে। জীবনে অসুখ-বিসুখ আসবেই কিন্তু তার কাছে পরাজিত হলে চলবে না। সাবিহার দাদীর কথা মনে পড়ে। তারও একটা স্তন পাথরের মতো শক্ত চাকা হয়ে হাড়ের সাথে লেগে গিয়েছিল। একটু চাপ লাগলেই রক্ত ঝরত। শেষের দিকে এমন দুর্গন্ধ ছড়াত যে আশপাশে কেউ যেতে চাইত না। তিন মাস এভাবে কষ্ট পাওয়ার পর দাদী মারা যান। গ্রামে থাকা দাদীর চিকিৎসাও তেমন করা হয়েছিল না তখন। সাবিহা ভাবে দাদীর মতো হলে চলবে না। ওর যতটা শক্তি আছে চিকিৎসা করার জন্য সেটা ব্যয় করবে। জীবনের কাছে পরাজিত হওয়া চলবে না।
Ñ ডাক্তার আমাকে খুলে বলুন আমার অবস্থা কি খুবই খারাপ? ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
না না আপনি ঘাবড়াবেন না। এর চিকিৎসা আছে। তবে ধৈর্য ধরে আপনাকে চিকিৎসা নিতে হবে। আমরা যারা চিকিৎসা দেবো তাদের আপনি সহযোগিতা করবেন। আপনি তো শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী। ফলোআপে থাকতে হবে। মনোবল হারাবেন না। চিকিৎসা নিলে আপনি ভালো থাকবেন।
আমি কি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব? নাকি সারা বছর হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে?
Ñ না না কী যে বলেন আপনি? আপনি পুরোদমে আপনার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সবই চালিয়ে যাবেন। শুধু মাঝে মধ্যে ফলোআপ আসতে হবে। অপারেশনের ওই ক’দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। তার পর আপনি হাসপাতালে আসা-যাওয়া করলেই চলবে।
Ñবাঁচালেন ডাক্তার। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে, আমার অনেক দায়িত্ব আছে। আমি সুস্থ জীবন চাই।
সাবিহার স্তনে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কিছু দিন ইনজেকশন দেয়া হলো। পরে অপারেশন করা হলো। সরকারি হাসপাতালেই। দুই ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। ইউনিভার্সিটির সহপাঠীরা টাকা, রক্ত ম্যানেজ করে দিয়েছিল। এখন সাবিহা দুর্বলতা অনুভব করলেও ক্লাস মিস করে না। বিসিএসের জন্য যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত। কেন লজ্জায় এবং কোনো কারণ ছাড়াই সে এত দেরি করে ডাক্তারের কাছে গেল? লজ্জা এবং ভয় এই দুই অন্তত অসুখের ব্যাপারে থাকতে নেই। ডাক্তার বারবার বলছিলেন, যদি আরেকটু আগে আসতেন তবে চিকিৎসা অনেকটা সহজ হয়ে যেত।
এ জন্য বলছি, প্রতিটি মেয়ে নিজে নিজের স্তন প্রতি মাসে অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখুন। স্তনের বোঁটায় চাপ দিয়ে দেখুন কোনো রক্ত পুঁজ বের হয় কিনা? স্তনে কোনো চাকা আছে কিনা নিজে নিজেই শনাক্ত করুন। কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়লে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাবেন। খবরদার পরে যাবো কিংবা লুকাবেন না। এতে সমস্যা আরো বেড়ে যাবে। যদি স্তন ক্যান্সারে আপনার বোন, মা, খালা, দাদী এ রকম কেউ আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে সে ক্ষেত্রে আপনারও ঝুঁকি কিছুটা থাকতে পারে। আপনি স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে জানুন। নিজে না বুঝতে পারলে যারা এ ব্যাপারে বোঝে তাদের সাথে শেয়ার করুন। স্তনে ব্যথা হতে পারে অনেক সময়। অনেকের আবার মাসিকের আগে স্তনে খুব ব্যথা হয়। ভারী ভারী লাগে। জামা কাপড়ের ছোঁয়া লাগলেও ব্যথা করে। বগলের নিচে কোনো চাকা আছে কিনা ভালোভাবে দেখুন। মোট কথা সুস্থ থাকার জন্য আপনাকেই আপনার দায়িত্ব নিতে হবে। ভালো থাকুন।
লেখক : গাইনোকোজিস্ট, চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শান্তি নগর শাখা, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement