১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নবজাতকের প্রথম ঘণ্টা

-

প্রতি বছর বিশ্বে চার মিলিয়ন নবজাতকের মৃত্যু ঘটে জন্মের চার সপ্তাহের মধ্যে। গবেষণা প্রকাশনায় দেখা গেছে, ২২ শতাংশ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে যদি নবজাতকের জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করা যায়।

বিশ্বে সব নবজাতকের জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা সম্ভব হলে চার মিলিয়ন নবজাতক মৃত্যুসংখ্যার মধ্যে এক মিলিয়নের জীবন রক্ষা পাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর প্রথম ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করানোই সর্বোৎকৃষ্ট কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা; যা পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুমৃত্যুর হার শতকরা ১৩ ভাগ কমাতে পারে। শিশুর ছয় মাস বয়সের পর থেকে ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধের পাশাপাশি সঠিকভাবে বাড়তি খাবার দিলে পাঁচ বছর বয়সের নিচে আরো শতকরা ছয় ভাগ শিশুর মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। এভাবে মায়ের দুধ পান সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (MDG-4) পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ঘণ্টা : জন্মের পরপরই যখন একটি সুস্থ নবজাতককে উষ্ণ রাখার জন্য মায়ের পেট এবং বুকে রাখা হয়, তখন তারা অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে এবং তারা সচেতন থাকে। শিশুরা এ সময় আস্তে আস্তে সামনের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হতে পারে। মায়ের নরম স্পর্শে তারা উদ্দীপিত হয়ে পেট অতিক্রম করে বুকের কাছে পৌঁছায় এবং মায়ের স্তন স্পর্শ করে। শিশুর নরম হাত বা মাথার স্পর্শে উদ্দীপিত হয়ে মায়ের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসারিত হয়, যার ফলে বুকের দুধের প্রবাহ শুরু হয় এবং শিশুর প্রতি মায়ের ভালোবাসাও বৃদ্ধি পায়। এরপর শিশু মায়ের শরীরের গন্ধ নেয়, মুখ দিয়ে স্তনের বোঁটা ঘষে এবং অবশেষে মায়ের বুকে মুখ লাগিয়ে দুধ খাওয়া শুরু করে। পর্যায়ক্রমিক এই আচরণগুলো শিশুর বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও বহু লেখক ও গবেষক নবজাতকের এই আচরণগুলোকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা দিয়েছেন, আমরা বর্তমানে মা ও শিশুকে এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগদানের গুরুত্ব আবিষ্কার করছি। প্রথমবারের মতো গবেষকেরা নবজাতকের মৃত্যুহারের ওপর মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরুর সময়ের প্রভাব মূল্যায়ন করেছেন। যাতে দেখা যায়, নবজাতকের মৃত্যুর হার অনেক কমে যায় যদি জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ানো শুরু করা হয়।
জন্মের পরে শিশুর ত্বকের সাথে মায়ের ত্বকের সংস্পর্শ এবং জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো গুরুত্বপূর্ণ কেন?
০১. মায়ের শরীর শিশুকে যথোপযুক্তভাবে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে, যা কিনা ছোট এবং কম ওজন (২.৫ কেজি) নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
০২. এ অবস্থায় শিশুর অস্থিরতা থাকে না এবং তারা শান্ত থাকে; শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎপিণ্ডের হার স্বাভাবিক থাকে। ০৩. শিশু প্রথমে মায়ের শরীরের জীবাণুর সংস্পর্শে আসে যেগুলোর বেশির ভাগই ক্ষতিকারক নয় অথবা মায়ের দুধে এসব জীবাণুর প্রতিরোধক উপাদান থাকে। মায়ের জীবাণু শিশুর অন্ত্র¿ ও ত্বকে অবস্থান করে এবং পরিবেশের বেশি ক্ষতিকারক জীবাণুর সাথে প্রতিযোগিতা করে, যার ফলে শিশুরা রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। ০৪. শিশু প্রথম খাবার হিসেবে শালদুধ গ্রহণ একটি স্বর্ণমান এবং শালদুধকে জীবনের প্রথম উপহার হিসেবে অভিহিত করা যায়।
* শালদুধ উমিউনোলোজিক্যালি সক্রিয় কোষ, এন্টিবডি ও অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং এটি শিশুর প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে। শালদুধ বহু রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং এটি শিশুর নিজস্ব তৈরি প্রতিরোধ প্রণালীতে নিয়ন্ত্রিত করতে সহায়তা করে।
* শালদুধে শরীর বৃদ্ধিকারক উপাদান থাকে, যেটা নবজাতকের পরিপাচক অন্ত্রগুলোকে পরিপক্ব ও কার্যকর করতে সহায়তা করে। এর ফলে শিশুর শরীরে রোগ সংক্রমণ ও অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়া কঠিন হয়।
* এটি ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ যা শিশুর চোখ সুরক্ষিত রাখে এবং সংক্রমণ কমায়।
* এটি শিশুর পরিপাচক অন্ত্রগুলোকে উদ্দীপ্ত করে, যাতে করে অন্ত্র থেকে দ্রুত মিকোনিয়াম পরিষ্কার হয়। এই ব্যবস্থা জন্ডিস সৃষ্টিকারী উপকরণকে শিশুর শরীর থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করে।
* শালদুধ অল্পমাত্রায় আসে, তবে এই পরিমাণই নবজাতকের জন্য যথেষ্ট।
০৫. শিশু মায়ের স্তন স্পর্শ, মুখে নেয়া এবং চোষার ফলে অক্সিটোসিন হরমোন নির্গত হয়, যা অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।
* অক্সিটোসিন হরমোন জরায়ুর সঙ্কোচন ঘটায়, যা দ্রুত গর্ভ ফুল পড়তে সহায়তা করে এবং প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ হ্রাস করে।
* অক্সিটোসিন অন্যান্য হরমোনকে উদ্দীপ্ত করে, যার ফলে মা শান্ত, অবসাদমুক্ত বোধ করেন এবং শিশুর সাথে মায়ের ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়।
* অক্সিটোসিন মায়ের স্তন থেকে দুধের প্রবাহ উদ্দীপ্ত করে।
০৬. মায়েরা তাদের সন্তানের সাথে এই প্রথম যোগাযোগে অতিশয় আনন্দ বোধ করেন এবং বাবারাও প্রায়ই এ আনন্দ উপভোগ করেন। এভাবে মা ও শিশুর মধ্যে বন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সার্বিকভাবে মা ও শিশুর পারস্পরিক ত্বকের সংস্পর্শে এবং শালদুধসহ মায়ের দুধ খাওয়ানো দ্রুত শুরু করার সাথে জন্মের প্রথম মাসে শিশু মৃত্যুহার হ্রাস সম্পর্কযুক্ত। এ বিষয়গুলো জন্মের প্রথম ছয় মাসে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো এবং পরবর্তী মাসগুলোয় দীর্ঘ সময় ধরে সফলভাবে মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়াও সম্পর্কযুক্ত, যা শিশুর উন্নত স্বাস্থ্য এবং পরবর্তী সময়ের মৃত্যুহার হ্রাসকেও প্রভাবিত করে।

সূত্র : বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন


আরো সংবাদ



premium cement