১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লিম্ফোমা

লিম্ফোমা
যাদের গ্লান্ডুলার ফিভার হয়েছিল তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে তিন গুণ বেশি - সংগৃহীত

লিম্ফোয়েড সিরিজের কোষগুলোর ক্যান্সারের ফলে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, এতে বিভিন্ন লিম্ফোয়েড টিস্যু বা লিসকা কলা বা গ্রন্থি ব্যথাহীনভাবে ক্রমান্বয়ে আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে শরীরের ইমিউনো সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ প্রক্রিয়াতেও অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়। এটিই লিম্ফোমা। ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে লসিকা গ্রন্থিতেই হতে পারে বা দূরবর্তী কোনো ক্যান্সার থেকে লসিকা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য হতে পারে। লিম্ফোমা বা লসিকা গ্রন্থির ক্যান্সার দুই ধরনের হতে পারে-

১. হজকিন্স লিম্ফোমা

২. নন হজকিন্স লিম্ফোমা

হজকিন্স লিম্ফোমা
প্রতি বছর প্রতি লাখে চারজন করে মানুষ হজকিন্স লিম্ফোমাতে আক্রান্ত হয়। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি। দুই ধরনের বয়স গ্রুপের মধ্যে এর প্রবণতা দেখা যায়। তা হলো ২০-৩৫ বছর বয়স গ্রুপ ও ৫০-৭০ বছর বয়স গ্রুপ।

কারণ 
এ রোগের অধিকাংশ কারণই অজানা। তবে দেখা গেছে যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের অধিকাংশই সুশিক্ষিত ও ছোট পরিবারের সদস্য।
যাদের গ্লান্ডুলার ফিভার হয়েছিল তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে তিন গুণ বেশি।

রোগের লক্ষণ
জ্বর থেমে থেমে আসে। ১০-১৫ দিন একটানা জ্বর চলল আবার ১০-১৫ দিন জ্বর নেই। তারপর আবার শুরু হলো। এভাবে পালাক্রমে চলতে থাকে।

রাতে ঘেমে যায়, ওজন আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

হাড়ে ব্যথা, সারা গায়ে চুলকানি হয়।

লসিকা গ্রন্থিগুলো আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে প্রথমে ব্যথাহীন থাকে। প্রথমে গলা এবং ঘাড়ের আশপাশের লসিকা গ্রন্থিতে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। আস্তে আস্তে গ্রন্থিগুলো বড় হতে হতে রাবারের মতো হয়ে যায় এবং এর উপরকার ত্বকের সাথে এটে থাকে না। এরপর গ্রন্থিগুলোতে ব্যথা অনুভূত হয় এবং বড় আকারের জন্য নিকটবর্তী কলার ওপর চাপ দেয় এতে আবার অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হতে পারে।

যেমন : ১. শ্বাসকষ্ট
২. খাবার গিলতে অসুবিধা
৩. পেটে ব্যথা
৪. জন্ডিস
৫. স্নায়ুর ওপর চাপের ফলে প্রদাহ
৬. মেরুদণ্ডে আক্রমণের জন্য দুই পায়ের অসাড়তা

রোগ নির্ণয়
১. রোগ সম্পর্কিত প্রাপ্ত ইতিহাস
২. রোগের লক্ষণ ও শারীরিক পরীক্ষা
৩. ল্যাব পরীক্ষা

লসিক গ্রন্থিত বায়োপসি (নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা)
-রেড স্টার্নবার্গ জায়েন্ট কোষের উপস্থিতি

রক্ত পরীক্ষা
১. শ্বেতকণিকার সংখ্যা বিশেষ করে নিউট্রোফিল ও ইয়োসিনোফিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, লিম্ফোসাইটের হিমোগ্লোবিনের মতো কমে যায়।
ব্লাড ফিল্ম- লোহিত রক্ত কণিকার আকার ছোট হয়।
রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেশি হয়। লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিনের মাত্রা বাড়ে।

অন্যান্য
১. বুকের এক্সরে
২. আলট্রাসনোগ্রাফি
৩. কিউনি ও লিভারের কার্যকারিতার পরিমাপ পরীক্ষণ
৪. অস্থিমজ্জা, প্লিহা, লিভার বায়োপসি
৫. সিটি স্ক্যান ইত্যাদি।

রোগের চিকিৎসা
এ রোগের চিকিৎসা করা হয় রোগের পর্যায় অনুসারে।
পর্যায় ১ একটি গ্রুপের লসিকা গ্রন্থির বৃদ্ধি
পর্যায় ২ মধ্যচ্ছদার একই দিকে একাধিক স্থানে লসিকা গ্রন্থির বৃদ্ধি
পর্যায়-৩ মধ্যচ্ছদার দুই দিকে লসিকা গ্রন্থির বৃদ্ধি
পর্যায়-৪ লিভার, প্লিহা, হাড় বা অন্যান্য কলাতে ছড়িয়ে পড়া।

যেসব চিকিৎসাব্যবস্থা আছে তা হলো
রেডিও থেরাপি
কেমোথেরাপি
রেডিও ও কেমোথেরাপি একসাথে

সার্জারি
১. পর্যায় ১ ও পর্যায় ২ এর ক্ষেত্রে সার্জারির পর রেডিও থেরাপি,
২। পর্যায় ৩ ও পর্যায় ৪-এর ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দেয়া হয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ, ২, ইংলিশ রোড, ঢাকা। ফোন: ০১৬৭৩৪৪৯০৮৩ (রোমান)

 

কিডনির প্রদাহ হলে

অধ্যাপক ডা: তোফায়েল আহমেদ

বেঁচে থাকার জন্য আমরা যে প্রতিনিয়ত খাবার বা পথ্য গ্রহণ করে থাকি তা শরীরে ব্যবহৃত হওয়ার পর যে বর্জ্য পদার্থ জমা হয় তা প্রধানত কিডনি দিয়েই বের হয়ে আসে। আর তাই কিডনিকে একটি নিখুঁত ছাকনির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। অবশ্য ছাকনির কাজে ছাড়াও কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যেমন সাহায্য করে ঠিক তেমনি সাহায্য করে রক্ত তৈরিতে এবং অস্থির গঠনে।

কিডনির প্রাথমিক রোগে বা অন্য কোনো কারণে কিডনি আক্রান্ত হয়ে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং নানা ধরনের কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে।

কিডনির প্রদাহ : বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ অত্যন্ত বেশি। ৫-১৫ বছরের শিশুরাই সাধারণত নেফ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত হয় এবং মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি। ছেলেমেয়ে হার হলো ২:১। বিশেষ ধরনের স্ট্রেপ্টোকক্কাস নামক জীবাণু দিয়ে শিশুর গলায় প্রদাহ হলে বা চর্মরোগ-খুজলি, খোস-পাঁচড়া হলে এর জটিলতা হিসেবে সাধারণত দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে নেফ্রাইটিস রোগ দেখা দেয়। অনেকক্ষেত্রে শুধু জ্বরের পরে এ রোগ দেখা দেয়।

লক্ষণগুলো : লক্ষণগুলো তাড়াতাড়ি বা হঠাৎ দেখা দেয় এবং তা মৃদু থেকে মারাত্মক হতে পারে।
১) আক্রান্ত শিশুর চোখ-মুখ ফোলা ফোলা মনে হয়। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠলে চোখের পাতা ফুলে যায়।
২) পায়ে এবং পেটেও পানি জমতে পারে।
৩) প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।
৪) প্রস্রাবের রঙ ঘোলাটে, কাঁচা চা অথবা কোকাকোলার মতো কিংবা লালচে হয়। এ রোগ হরে কিডনি দিয়ে রক্তের লোহিত কণিকা প্রস্রাবের সাথে বের হয়ে আসে, ফলে প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়। লোহিত কণিকার সাথে প্রোটিনও বের হয়ে আসে।
৫) শরীর ম্যাজ-ম্যাজ করা, দুর্বলতা, জ্বর-জ্বর ভাব, ক্ষুধা মন্দা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা ইত্যাদি থেকে শুরু করে সমস্ত শরীর ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, খিচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

এ রোগ হলে শিশুর রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা মারাত্মক রকম বেড়ে যেতে পারে। রোগের লক্ষণ দেখে এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করলে এ রোগ সহজেই নির্ণয় করা যায়। তবে রোগের কারণ এবং শরীরের বিভিন্ন সিস্টেমের ওপর কতটুকু প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নির্ধারণ করার জন্য রক্ত পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

চিকিৎসা : কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। চিকিৎসা প্রধানত উপসর্গভিত্তিক। সঠিক চিকিৎসা হলে নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত শতকরা ৯৭ শতাংশ শিশুই ভালো হয়ে যায়। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সব উপসর্গ দূর হয়ে যায় এবং শিশু স্বাভাবিক কাজকর্ম ও লেখাপড়া করতে পারে। রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার পর অন্তত দুই বছর ফলোআপে থাকা উচিত।

নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত শতকরা ০৫.-২ ভাগ শিশুর বেলায় অতি তাড়াতাড়ি কিডনি খারাপ হয়ে যেতে পারে এবং কয়েক মাসের মধ্যে কিডনির কার্যকারিতা স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। শিশুর চুলকানি, খোস-পাঁচড়া বা কোনো চর্মরোগ দেখা দিলে বা গলা ব্যথা হলে তা কখনই অবহেলা করা উচিত নয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করান দরকার।

দেরি করলে পরবর্তীকালে কিডনির প্রদাহ রোগ হতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে তাই রোগ প্রতিরোধের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

আকস্মিক কিডনি বিকল : যদি হঠাৎ করে কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে কয়েক দিনের মধ্যে কিডনির কার্যকারিতা দ্রুত লোপ পেতে থাকে, তাকে আমরা আকস্মিক বা একিউট কিডনি বিকল বলে থাকি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর প্রস্রাব কমে যায় এবং পরবর্তীকালে কিডনি দ্বারা প্রস্রাব তৈরি নাও হতে পারে।

রোগের লক্ষণ দেখে দ্রুত রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়াটিনিন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বনেট ইত্যাদি ইলেকট্রোলাইট পরীক্ষা করে দ্রুত চিকিৎসা করান প্রয়োজন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে কিডনি বিকল হওয়ার পরও সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব।

চিকিৎসা : চিকিৎসার প্রধান দিক হলো শরীরের জলীয় পদার্থ পূরণ এবং রক্তের লবণ, পটাশিয়াম এবং ক্ষার নিয়ন্ত্রণ এবং পূরণ করা। আর সে জন্যই আকস্মিক কিডনি বিকল হলে এর চিকিৎসা বড় বড় হাসপাতালে করা প্রয়োজন। অবশ্য এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার লক্ষ্যে সঠিক পদক্ষেপটি গ্রহণ করে নিকটস্থ চিকিৎসকের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে আকস্মিক কিডনি বিকল হওয়ার আগেই রোগীকে নিরাময় করা সম্ভব।

ধীরগতিতে কিডনি বিকল : ধীরে ধীরে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে যদি দুটি কিডনিরই কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে, তাকে আমরা ধীরগতিতে কিডনি বিকল বা ক্রনিক কিডনি ফেইলিউর বলে থাকি।

রোগীকে পরীক্ষা করে রক্তস্বল্পতা বোঝা যায়। বেশির ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে। এ ছাড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারণ সাপেক্ষে রোগীর শরীরে পানি দেখা দিতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে চামড়া শুকিয়ে যেতে পারে। কিছু রোগীর হৃৎপিণ্ডের আবরণে পানি এবং হার্টফেইলিউরের চিহ্ন দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে শরীরের এমনকি হাত-পায়ের মাংসপেশী শুকিয়ে রোগী চলাফেরার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে।

চিকিৎসা : চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে কি কারণে ও কত পরিমাণে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়েছে তার উপর। দুটো কিডনির শতকরা ৯৫ ভাগের উপরে যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে কোন ভাবেই কিডনির কার্যকারিতা ফিরানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement