২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বদলে গেছে শান্তির শহর

মুসলমানদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী - সংগৃহীত

শুক্রবার রাত মানেই তো আনন্দের রাত। এই রাতে নিউজিল্যান্ডের কোনো শহর এমনিতেই ঘুমায় না। আর এই শুক্রবারটা তো ছিল ১৭ মার্চ। সেন্ট পিটার্স ডে। আইরিশদের সবচেয়ে বড় সন্তের জন্মদিন। হাসি–আনন্দে–উৎসবে যা আরও রঙিন হয়ে ওঠার কথা। নানা আয়োজনে সাজছিল শহরের আইরিশ পাবগুলো। শুক্রবার রাতে যেখানে ভিড় উপচে পড়ার কথা। সেই শুক্রবার রাতেই ক্রাইস্টচার্চ যেন হয়ে উঠেছিল ভুতুড়ে এক নগরী!

রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য। এর সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি। অদ্ভুত একটা বিষন্নতা চারপাশে। ভয়াল এক শুক্রবার চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছে ক্রাইস্টচার্চকে। আসলে তো পুরো নিউজিল্যান্ডকেই। সহিংসাকবলিত পৃথিবীতে এই একটা দেশই হয়তো বাকি ছিল, যেখানে এত দিন সেই অর্থে সন্ত্রাসের কালো ছায়া পড়েনি। তাই তো নিউজিল্যান্ডকে বলা হতো শান্তির এক দেশ। যে দেশে নিশ্চিন্তে রাতবিরাতে যেখানে–সেখানে ঘুরে বেড়ানো যায়। বিমানবন্দরে চেক-ইন করার পরও যতবার ইচ্ছা বাইরে বেরিয়ে আবার ভিতরে ঢোকা যায়। যেখানে গুলির শব্দ শোনা যায় না, বোমা আওয়াজে কেঁপে ওঠে না। নিউজিল্যান্ডের অধিকাংশ পুলিশের কাছে এমনিতে কোনো অস্ত্রই থাকে না। থাকে শুধু ছোট্ট একটা লাঠি। সেই দেশকেও হতে হলো রক্তাক্ত!

ক্রাইস্টচার্চের মতো নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিউজিল্যান্ডে বিরল। এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের মোক্ষম উদাহরণ খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৪৩ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় এমন একটি অপরাধের খোঁজ মিলবে। নিকট অতীতের উদাহরণ খুঁজতেও ফিরে যেতে হবে গত শতাব্দীতে। ১৯৯০ সালের সেই ঘটনায় ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। সেই ঘটনার পিছনে ছিল প্রতিবেশীর সঙ্গে মনোমালিন্য। কিন্তু এবার যে ঘটনাটি ঘটল, তার সঙ্গে সরাসরি উগ্রবাদের সংযোগ পাওয়া গিয়েছে। এই প্রথম। ভাবতেই ডুকরে উঠছেন নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দারা। কারণ, মানুষই যখন মানুষের শত্রু হয়ে যায়, তখন তা প্রতিরোধ অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

অথচ, সন্ত্রাসের ছোঁয়া থেকে দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে, অস্ট্রেলিয়ার প্রচণ্ড চাপ উপেক্ষা করেও কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার পরিণতি দেখে আরো বেশি করে খুঁজে পেয়েছে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা। আর এক অস্ট্রেলিয়ানই রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে বদলে দিলো এই শান্তির দেশে! সবার একটাই অনুভূতি—অবিশ্বাস্য! নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক, রেডিও স্পোর্টের ব্রায়ান ওয়াডল বারবার মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, ‘এটাও কী সম্ভব! আমাদের দেশে এমন কিছু আগে কখনো হয়নি।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিউজিল্যান্ডে কখনো বর্ণবাদ বা উগ্রবাদের প্রকাশ্য আস্ফালন দেখা যায়নি। যদিও নিউজিল্যান্ডে অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। তবুও পারস্পরিক ঘৃণার প্রকাশ বা বিভক্তির নিদর্শন এখনো টের পাওয়া যায়নি। তবে হ্যাঁ, ধীরে ধীরে দেশটিতে অভিবাসনবিরোধী একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। নিউজিল্যান্ডের রাজনীতিতে ইসলামভীতির বিষয়টি কখনোই মাথাচাড়া দেয়নি। মুসলিমদের সংখ্যাও কম। সব মিলিয়ে ৫০ হাজারও হবে না। ইদানীং দেশটিতে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। এসব দেশের তালিকায় উপরের দিকে আছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।

যদিও ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র কিছু চিহ্ন ক্রাইস্টচার্চেও দেখা গেছে। ২০১২ সালে ক্যান্টারবুরি ডিস্ট্রিক্ট হেলথ বোর্ড এবং মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্রাইস্টচার্চে বেশ কিছু উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। ওই বছরই শতাধিক মানুষ সেখানে ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’র সমর্থনে বিক্ষোভও করেছিল। ২০১৭ সালে দেশটির পার্লামেন্টের সামনেও এমন একটি বিক্ষোভ হয়েছিল।

তবে অনেকের দাবি, এসবই হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ক্রাইস্টচার্চের সাবেক মেয়র ভিকি বাক বর্ণবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি মনে করেন, কয়েকটি ঘটনায় পুরো সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় না। তাছাড়া নিউজিল্যান্ডে তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি কট্টর জাতীয়তাবাদী। সাম্প্রতিক নির্বাচনে এই দলটি বেশ ভোট পেয়েছে। এই দলের প্রধান নেতা ম্যাভেরিক উইনস্টন পিটার্স এখন দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী। দলটি দেশের বর্তমান উদার অভিবাসন নীতি কঠোর করতে চায়। ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড প্রায় ৬৫ হাজার অভিবাসীকে স্বাগত জানিয়েছে। এই সংখ্যা কমিয়ে ১০ হাজারে নামাতে চান পিটার্সরা। সাম্প্রতিক হামলার পর সেই পালে হাওয়া লাগল বলে।

ঘটনার দিন দুপুরে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠে যত মানুষ ছিল, সবাই একটা রুমে একরকম বন্দি ছিলেন। যার পোশাকি নাম ‘লকড ডাউন’। ঘটনার পর পুরো ক্রাইস্টচার্চই খণ্ড খণ্ড ‘লকড ডাউন’–এর সমষ্টি। যে যেখানে ছিল, সেখানেই থাকতে হবে। শহর নিরাপদ মনে হলেই কেবল অনুমতি মিলবে বাইরে বেরনোর। হ্যাগলি ওভালে ‘হ্যাডলি প্যাভিলিয়ন’ নামে বিশাল হলরুমটাতে বাংলাদেশের সাতজন সাংবাদিক ছাড়া বাকি সবাই নিউজিল্যান্ডের। কেউ মোবাইলে সর্বশেষ অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। কারো চোখ টেলিভিশনে। দেখছেন আর তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠছে অবিশ্বাস আর চিরদিনের জন্য চেনা ক্রাইস্টচার্চকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। রক্তাক্ত লাশ। সারা শরীরে রক্ত নিয়ে হেঁটে আসতে থাকা তরুণ। সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলা একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স। সাবমেশিনগান হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ...। এক লহমায় বদলে যাওয়া এক শহর।

‘লকড ডাউন’ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমকে হোটেল নভোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলেন কেটলিন গডফ্রে নামে এক তরুণী। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন। যে কোম্পানির উপর দায়িত্ব ছিল হ্যাগলি ওভাল সাজানোর। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘এই শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখানে আমি কখনো একমুহূর্তের জন্যও নিরাপদহীনতা বোধ করিনি। আর এখানেই কি না...’। কথাটা শেষ করার আগেই তাঁর দুই চোখে পানির ধারা।

শুধু ক্রাইস্টচার্চে নয়, পুরো নিউজিল্যান্ডেই তো এত দিন কেউ কখনো নিরাপদহীনতা বোধ করেনি। নামাজ পড়তে যাওয়া বাংলাদেশ দলের বাসের সামনে–পিছনে পুলিশের গাড়ি দূরে থাক, বাসে যে একজন নিরাপত্তা কর্মীও ছিল না— নিউজিল্যান্ডে এটাই তো স্বাভাবিক। যেখানে টিম হোটেলেও বাড়তি কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়নি কখনও। ক্রিকেটাররা রাতের বেলায়ও যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। কখনো দু–তিনজন মিলে। কখনওবা একাই। এই সেই নিউজিল্যান্ড, যে বাকি বিশ্বের সঙ্গে ব্যতিক্রম হয়ে আকাশ–বাতাস ছড়িয়ে দিত শান্তির বার্তা। সেই বাতাসে এখন লাশের গন্ধ।

পরপর দুই বছরে দু’টি বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে আবার আগের রূপে ফেরার লড়াই শেষ হয়নি ক্রাইস্টচার্চের। ভাঙা ক্যাথিড্রাল, পরিত্যক্ত ভবন এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই দুঃস্বপ্ন। সেসব হয়তো আবারও আগের রূপে ফিরে আসবে কোনো একদিন।
কিন্তু ভয়াল ওই শুক্রবারের পর ক্রাইস্টচার্চ আর কখনো আগের মতো হবে না। নিউজিল্যান্ডও নয়!

সংগৃহীত


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ৩ মামলা তৃণমূল সংগঠনের মজবুতির জন্য কাজ করতে হবে : মাওলানা আব্দুল হালিম ‘দেশ ও জাতি দুঃসময় পার করছে’ ওসমানীনগরে বাস-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২ সহ-অধিনায়ক হতে পারেন রিজওয়ান মেক্সিকোয় মেয়র প্রার্থী ছুরিকাঘাতে নিহত রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহেও ক্লাস বন্ধ ঘোষণা দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন : প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের শোষণ থেকে জনগণকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার সিংড়ায় প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে প্রার্থীতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আ’লীগের

সকল