২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোল দিয়ে যা বললেন পগবা

গোল দিয়ে যা বললেন পগবা - ছবি : সংগৃহীত

ক্রোয়েশিয়ার জালে বল জড়ানোর পর বাজপাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ছিল একটা লক্ষ্য পূরণের আস্ফালন। আসলে ফাইনালের আগে পর্যন্ত পল পগবার না ছিল কোনো গোল, না পা থেকে বেরিয়েছে গোলের পাস। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রান্সের তারকা মিডফিল্ডারের কার্যকরী ফুটবল কদর পাচ্ছিল না। পগবা তার সেরাটা দিতে পারছেন না, এমন মন্তব্যও কেউ কেউ করেছিলেন তার লেখায়। এটাই ভেতরে ভেতরে তাতিয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ফুটবলারকে। তাই গোলের পর নিজের জার্সিটা চেপে ধরে বুকের কাছে হাত মুঠো করে ঠুকছিলেন তিনি। যেন বোঝাতে চাইলেন, এটাই আসল আমি। খাটো করে দেখো না। সময়মতো জ্বলে উঠতে জানি।

সত্যি পোগবা যেন ম্যাচ শেষে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে অঝোর ধারায় বর্ষণের মাঝে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে সাফল্যের আনন্দে মেতেছিলেন পোগবার সতীর্থরা। পতাকায় নিজেদের মুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন আবেগের জোয়ারে ভেসে। আঁতোয়া গ্রিজম্যানের আনন্দাশ্রু মিশেছিল গাল বেয়ে পড়া বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায়। এমবাপে বুক ঠুকছিলেন উমতিতির সঙ্গে। কোচ দিদিয়ের দেশঁ ফুটবলারদের বুকে জড়িয়ে একটু সরে থেকে বিশ্বকাপ জয়ের তৃপ্তি অনুভব করতে চেষ্টা করছিলেন। পগবার সেটা নজর এড়ায়নি।

ব্যস সতীর্থদের জুটিয়ে নিয়ে কোচ দেশঁকে শূন্যে তুলে লোফালুফি শুরু। তাতেও পগবার যেন আশ মিটছিল না। বুঝতে পারছিলেন না, আরো কীভাবে বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তগুলোকে রঙিন করে তোলা যায়। সোনার পদক গলায় পরে বিহ্বল। পুরস্কার মঞ্চের ধারে দাঁড়িয়ে ছটফট করছিলেন বিশ্বকাপটা হাতে ধরার জন্য।

ফিফা সভাপতি ইনফ্যান্টিনোর হাত থেকে অধিনায়ক হুগো লরিস বিশ্বকাপ হাতে ধরামাত্র বাঁধনহারা সোনালি উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ। হাতে হাতে ঘুরছিল সোনার কাপ। পোগবার কাছে পৌঁছতে সেটা আর হাতছাড়া করতেই চাননি তিনি। বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিলেন পরম তৃপ্তিতে। চুমু খেয়েই চলেছিলেন। লুঝনিকি স্টেডিয়ামের গ্যালারির দর্শক আর মিডিয়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল পগবার পাগলামি।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রঁর সঙ্গে নাচের তালে পা মেলাতে ছাড়েননি পোগবা। অবশ্য তখনও আরও এমন পাগলামি দেখার বাকি ছিল। সেটা টের পাওয়া গেল সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে। পগবার নেতৃত্বে যেভাবে গোটা ফ্রান্স দলটাই সংবাদ সম্মেলন কক্ষে ঢুকে শ্যাম্পেন ছিটিয়ে, কোচ দেশঁকে জড়িয়ে ধরে, টেবিলে উঠে দেশ আর দেশঁর নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে নেচেগেয়ে মাত করে দিলেন, তা সারাজীবনেও ভোলা যাবে না। ফিফার ফুটবল ইতিহাসে এমন স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের ‘‌হামলা’‌ এর আগে সংবাদ সম্মেলনের মাঝে হয়নি। এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা প্রচারমাধ্যমের কাছে।

পগবা যেন ফুটবলের পাবলো পিকাসো। যিনি তুলি দিয়ে নয়, ফুটবলের রঙে সবুজ ঘাসের ক্যানভাসে সাফল্যের ছবি আঁকেন। ভেতরে ভেতরে কতটা জ্বালা থাকলেই না এমন উচ্ছ্বাসের লাভা স্রোত বেরিয়ে ভাসিয়ে দেয় অন্যদের।

ফাইনালের আগেই পগবা বলেছিলেন, ২০১৬ ইউরো কাপের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চান না। ভুলের খেসারত দিয়ে ডুবতে হয়েছিল। এবার বিশ্বকাপটা চাই–‌ই। সেটা মাথায় ছিল বলেই ফাইনাল খেলতে নামার আগে সতীর্থদের সাজঘরে উজ্জীবিত করতে বলেছিলেন, ‘‌ছোটবেলা থেকে বিশ্বকাপ জেতা আমার স্বপ্ন। এই দলের বাকিদেরও। আর সেই স্বপ্নপূরণ থেকে আমরা ঠিক ৯০ মিনিট দূরে। ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়া থেকে ঠিক ৯০ মিনিট দূরে। গোটা ফ্রান্সকে উৎসবে মেতে ওঠার সুযোগ দিতে আমাদের উজাড় করে দিতে হবে ঠিক ৯০ মিনিট। দেশের ছেলেমেয়েরা, এমনকি তাদের পরের প্রজন্মের মুখে আমাদের সাফল্য ঘুরবে যুগ যুগ ধরে। এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে পারি না। চলো, আমরা স্বপ্ন পূরণ করে দেখাই। দুটো দল, একটা কাপ, আমরা অন্যদের তাতে থাবা বসাতে দেব না।’‌

পগবার কথাগুলো যে সতীর্থদের সেরা দিতে টনিকের মতো কাজ করেছে, তা বোঝাই গেছে খেলায়। এমবাপে গোলের পর পোগবার সামনে সেলিব্রেশনের ভঙ্গির মধ্যে সেই ইঙ্গিত। পগবা আগেই বলেছিলেন, ১৯৯৮–এ ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের ঘটনা তাকে প্রেরণা জোগায়। একটা তারা লাগানো জার্সি পরে খেলতে গর্ব বোধ করেন। তবে যেহেতু সেটাতে তাদের কোনো অবদান ছিল না, তাই দ্বিতীয় তারা লাগাতে মরিয়া নিজেদের কৃতিত্বে।

সেই লক্ষ্য পূরণে অভিভূত পগবা। বলেন, ‘‌বলে বোঝাতে পারব না, বিশ্বকাপ জয়ের অনুভূতিটা কতটা মধুর, রোমাঞ্চর। মনে হচ্ছে আকাশে ভাসছি। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে বসে ৯৮ বিশ্বকাপ জয়ের ভিডিও বারবার দেখতাম। ভাবতাম কবে এভাবে আমাদের হাতে কাপ উঠবে। সেলিব্রেশনে মাতব। সেই সুখ, তৃপ্তিটা পাচ্ছি বিশ্বকাপ জিতে। তবে মিস করছি বাবাকে। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের দেখছেন, খুশি হচ্ছেন যেখানেই থাকুন। এই জয়টা সতীর্থ, কোচ, কোচিং স্টাফ, কিট ম্যানদের মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। সাফল্য উৎসর্গ করছি দেশবাসীকে। তাঁরা এমন একটা দিনের জন্য গত ২০ বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন। ইউরো ১৬–‌তে হেরে আমরা ওদের হতাশ করেছিলাম। এখন ওঁরাও সুখী আমাদের মতো।’‌

কোচ দেশঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ পগবা। বলেন, ‘‌শুরুতে আমরা যেমন সহজ ছিলাম না তার ব্যাপারে, তেমনি উনিও নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরেননি। পরে খোলামেলা মেজাজে মিশতে শুরু করতে তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা দারুণ হয়ে যায়। উনি যেটা চেয়েছেন, সেটাই মাঠে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বিশ্বকাপ জয়ে তাই দেশঁর অবদান কোনও অংশে কম নয়।’‌ বিশ্বকাপ জিতে বিদ্রুপ করেছিলেন ইংল্যান্ডের সমর্থকদের দিকে ইঙ্গিত করে। ইংল্যান্ডের সমর্থকদের ‘‌ ইটস কামিং হোম’‌ গানের সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠে। এতে ম্যাঞ্চেস্টারের সমর্থকরা অখুশি হতে পারেন ভেবে চটজলদি নিজেকে শুধরে নিয়ে বলেছেন, ‘‌ এটা নিতান্তই মজা। কাউকে আঘাত দিতে নয়।’‌‌


আরো সংবাদ



premium cement