১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্বকাপের মাঠে সেজদাহে অবনত সালাহকে দেখা যাবে না!

সালাহ
মোহাম্মদ সালাহ - সংগৃহীত

ইনজুরি খুবই গুরুতর। সেরে উঠতে মাস দেড়েক লাগতে পারে। ততদিনে বিশ্বকাপ পাড়ি দিয়ে দিবে অনেকটা পথ। ফলে মাঠে দেখা যাবে না সেজদাহে অবনত সালাহকে! পরিস্থিতি এখন এমনটাই। সংবাদ সম্মেলেন তার বস ক্লপ এই আভাসই দিলেন।

শনিবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের সার্জিও রামোসের বাজে ট্যাকেলে মাঠে লুটিয়ে পড়েন সালাহ। এরপর ব্যাথা নিয়েও খেলতে নামেন তিনি। কিন্তু মিনিট কয়েক পরে আবারো মাঠে পড়ে যান। পরে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন তিনি।

এই ঘটনার পর সংবাদ সম্মলনে লিভারপুল বস বলেন, 'এখন এইটুকু বলতে পারি যে, সালাহর ইনজুরি খুবই গুরুতর! হ্যা, অনেক বেশি গুরুতর।'

তিনি বলেন, 'হাসপাতালে তার এক্স-রে করা হচ্ছে। এটা হয়তো কাঁধের সংযোগস্থল বা ঘাড়ের ইনজুরি। তবে যেটাই হোক, খুবই গুরুতর ইনজুরি। তার অবস্থা একদমই ভালো মনে হচ্ছে না।'

কাঁধ অথবা ঘাড়ের এই ধরণের ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে কমপক্ষে চার থেকে ছয় সপ্তাহ প্রয়োজন। অথচ বিশ্বকাপ শুরু হতে বাকি মাত্র দুই সপ্তাহ! সেই হিসেবে, মিসরকে দীর্ঘ সময় পর বিশ্বকাপের টিকেট পাইয়ে দেয়া এই রাজপুত্রের বিশ্বকাপ খেলা হবে না। ফুটবলবিশ্ব হারাবে এক রাজপুত্রকে, যে কিনা মুসলিম-অমুসলিম সবার অনুপ্রেরণা ছিল। যাকে বিশ্বকাপে দেখতে মুখিয়ে আছে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী।

 

ধর্মপ্রাণ সালাহ'য় অনুপ্রাণিত অমুসলিমরা

সাবরিনা সোবহান

মোহাম্মদ সালাহ ঘালে। মিসরের এই ফুটবল সেনসেশন লিভারপুলের হয়ে এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফুটবলবিশ্বে এতো দ্রুত কোনো মুসলিম খেলোয়াড় আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেননি, যতটা করেছেন ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ। মাঠে এবং মাঠের বাইরে দুই জায়গায় তুমুল জনপ্রিয় তিনি। মুসলিম বলে ধর্মচর্চায় কোন রাখ-ঠাক করেন না তিনি। প্রতিপক্ষের জালে বল ছুড়েই মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেজদাহে অবনত হন, দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন। ধর্মপ্রাণ সালাহ'য় শুধু মুসলিম নন, অনুপ্রাণিত অমুসলিমরাও। তার বাম পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে অনেক অমুসলিমরাও এখন মুসলমান হতে রাজি। তারা প্রিয় এই খেলোয়াড়ের সাথে মসজিদে পর্যন্ত যেতে চান। এই ইচ্ছা তারা প্রকাশ করেছেন গানে গানে-

'যদি সে তোমার জন্য ভালো হয়, তবে সে আমার জন্যও ভালো।

যদি সে আমাদের জন্য আরো কিছু গোল করে, তবে আমরা মুসলিম হতেও রাজি।

যদি সে তোমার জন্য ভালো হয়, তবে সে আমার জন্যও ভালো।

যদি সে মসজিদে যায়, তবে আমিও সেখানে যেতে রাজি।'

সালাহকে নিয়ে ভক্তদের 'আমিও মুসলিম হবো' শিরোনামের এ গানটি এখন ভাইরাল। সালাহ মাঠে ঢুকতেই গ্যালারি থেকে ভেসে আসে এই সুর। সালাহ এবং তাকে নিয়ে বাধা এই গানের সুবাদে অনেকেই এখন লিভারপুলের ভক্ত হচ্ছেন।

কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রেট ব্রিটেনের মুসলিম বিদ্বেষ কমিয়ে এনেছেন মোহাম্মদ সালাহ।

বিবিসি'র সাংবাদিক রাবিয়া লিমবাদা সালাহর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি বলেছেন, 'তার সন্তানদের কাছে সালাহ এখন রোল মডেল। তার খেলা, মাঠে দুই হাত তুলে মোনাজাত করা, তার দাড়ি - সবকিছুই তাদের একজন মুসলিম হিসেবে গর্বিত করছে।'

তার ভাষ্য, 'সালাহ ব্রিটেনে মুসলিমদের সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিচ্ছেন - যে ব্রিটেনে এখনকার পরিবেশে মুসলিমদের তাদের ইসলামিক ঐতিহ্য প্রদর্শন করতে দুইবার ভাবতে হয়। কিন্তু অনেক দিন পর মোহাম্মদ সালাহর মধ্যে আমরা এমন একজন মুসলিমকে পাচ্ছি, যাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সালাহ ব্রিটেনের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে পরস্পরের সাথে যুক্ত করছেন।'

তিনি বলেছেন, 'তার বন্ধুদের মধ্যে যারা লিভারপুলে সমর্থক এবং মুসলিম নন, তারাও এ ব্যাপারটা উপলব্ধি করছেন। তাদের কথা, মোহাম্মদ সালাহর উত্থানের গুরুত্ব এখানেই যে, তিনি সংকীর্ণ মানসিকতার লোকদের চিন্তাভাবনার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সালাহ তার মুসলিম পরিচয় নিয়ে কোন রাখঢাক করেন না।'

রাবিয়া বলেন, 'সালাহ তার সন্তানদের জন্য এবং তাদের মতো অন্যদের জন্যও অনেক বড় অনুপ্রেরণা।'

শুধু রাবিয়া নন, লিভারপুল ক্লাবের এক সদস্য আসিফ বদিও এমনটা মনে করেন। তার মতে, 'সালাহ যেভাবে খেলছেন তাতে নিঃসন্দেহে লিবারপুলে মুসলিম ভক্ত বাড়াতে সাহায্য করছেন।'

বিদেশের মাটিতে যার এমন ভক্ত, দেশে তার ভক্তের সংখ্যা কেমন হবে তা হয়ত অনুমান করা কঠিন হবে না। মিসরে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছেন সালাহ। দেশকে বিশ্বকাপের টিকেট এনে দেয়ার পর এই সম্মানে ভূষিত হন তিনি।

আর জন্মস্থান নাগরিগে তার জনপ্রিয়তা কেমন?

১৯৯২ সালের ১৫ জুন মিসরের নাগরিক শহরের বাসিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সালাহ। এই অজপাড়া গাও থেকে আজকের এই সফলতার পেছনে তার যে সংগ্রাম - তাতে অনুপ্রাণিত তার গ্রামবাসীরা। অনেকে এখন সালাহ'র মতো হতে চান।

শহরের তিন তলার যে বাড়িটায় সালাহ বেড়ে উঠেছেন, সেখানে এখন স্বপ্ন দেখছেন ১২ বছর বয়সী মোহাম্মদ আবদেল। সালাহ তার আদর্শ। প্রিয় ফুটবলারকে নিয়ে সে বলে, 'নীতি-নৈতিকতা ও মহানুভবতার কারণে সালাহ এখন পেশাদার ফুটবলার হয়েছেন। আশা করছি বড় হয়ে আমিও সালাহ'র মতো হবো।'

নাগরিগের তরুণ ও শিশুদের সব সময় স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রেরণা যোগান সালাহ। আফ্রিকার সেরা ফুটবলার হওয়ার পর পুরস্কার হাতে মঞ্চে সালাহ বলেছিলেন, 'কখনো স্বপ্ন দেখা বন্ধ করবে না। কখন বিশ্বাস করাও বন্ধ করবে না।' তাই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন নাগরিগবাসী।

মিসরে সালাহ'র জনপ্রিয়তা কত সম্প্রতি একটি ঘটনায় তার প্রমাণ মিলেছে। গত মার্চে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন সালাহ। পেয়েছেন ১০ লাখ ভোট!

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। নির্বাচনে আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি ও মুসা মোস্তফা মুসার অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন সালাহ। এই দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি যাদের অপছন্দ ছিল, তারাই ভোট দিয়েছেন সালাহকে। সিসি ও মুসার নাম কেটে তারা নিচে লিখে দিয়েছেন মোহাম্মদ সালাহর নাম।

এই দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি যাদের অপছন্দ ছিল, তারাই ভোট দিয়েছেন সালাহকে। সিসি ও মুসার নাম কেটে তারা নিচে লিখে দিয়েছেন মোহাম্মদ সালাহর নাম


নির্বাচনে ৯২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন সিসি। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি মুসা পেয়েছেন মাত্র তিন শতাংশ ভোট। আর প্রতিদ্বন্দ্বি না করেই মুসার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন সালাহ। ১০ লাখ ভোটার দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে চেয়েছেন সালাহকে। তার মানে ভবিষ্যতে তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাচ্ছেন মিসরবাসীরা।

এর আগে গত মার্চে দেশটির মোবাইল কোম্পানি ভোডাফোন সালাহর একটি গোলের জন্য ১৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করার ঘোষণা দেন। সালাহ লিভারপুলের হয়ে একটি গোল করার পর কোম্পানির প্রতিটি গ্রাহক ১১ মিনিট করে ফ্রি কথা বলতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ৪৩ মিলিয়ন। সেই হিসেবে ১১ মিনিট করে কথা বললে তাদের খরচ ১৪০ মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় এক হাজার এক শ' ৯০ কোটি টাকা।

এতো গেলো দেশের কথা। সালাহর জীবন-যাপনে মুগ্ধ হয়ে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ মক্কায় তাকে একখণ্ড জমি উপহার দেয়ার কথা জানিয়েছেন। যদি তা করা সম্ভব না হয়, তবে সালাহর নামে একটি মসজিদ বানানোর কথাও বলেন মক্কা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ফাহাদ আল রওকি। সৌদি পত্রিকা সাবক’কে নিজের এই প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়ে বলেন, ‘এই মিসরীয় যুক্তরাজ্যে ইসলামের 
একজন অসাধারণ দূত। তার জন্য আমাদের এই অবস্থান তরুণ প্রতিভাদের এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করবে।’

তিনি আরো জানান, 'জমির ধরন নিয়ে পছন্দ-অপছন্দের বিষয় রয়েছে। সৌদি সরকারের নিয়ম মেনে যদি জমি দেয়া যায় তাহলে সালাহকে মসজিদুল হারামের ঠিক বাইরেই একখণ্ড জমির স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আর যদি জমি দেয়ার কোনো নিয়ম না থাকে তাহলে সালাহের নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। যদি সেটাও নিয়মের মধ্যে না থাকে, তাহলে সালাহ নিজে থেকে জমির জন্য 
আবেদন করতে পারবেন। আমি সেটার ব্যবস্থা করে দেব। তিনি জমি বিক্রি করে টাকা নিতে পারবেন অথবা জমিতে নিজের নামে কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিতে পারবেন।'

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা লিভারপুলের এ ফরোয়ার্ডকে দলে টানতে এখন মরিয়া ফুটবলবিশ্বের শীর্ষ দুই ক্লাব- লিওলেন মেসির বার্সেলোনা ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ। তবে দুটির কোনো ক্লাবেই যাবেন না সালাহ, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সালাহকে এই পর্যায়ে আসতে অনেকটা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। লিবারপুলের ওয়েবসাইটে এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছেন সেই কথা। তার ভাষ্য, 'সপ্তাহে পাঁচ দিন আমার ট্রেনিং ছিল। শহর থেকে অনেক দূরে রাজধানী কায়রোতে। সেখানে যাওয়ার জন্য সকাল ৯টায় রওনা হতাম। গন্তব্য এতোটাই দূরে ছিল যে, আমাকে ছয়টি বাস বদলাতে হতো। 
তারপর সেখানে গিয়ে ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরতাম রাত ১০টায়। তারপর ক্লান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।'

সালাহ এখানে যে সময়ের কথা বলছেন, সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৪। সেই বয়সেই ফুটবলের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। তাদের স্কুলে আয়োজন করা হয়েছিল পেপসি লিগ। আরব কন্সট্রাক্ট্রর এফসি নামের একটি ক্লাব সেটির আয়োজন করেছিল। সেই লিগে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে আয়োজকদের নজর কেড়েছিলেন সালাহ। পুরস্কার হিসেবে ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে কায়রোতে ট্রেনিংয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। সেই প্রস্তাব লুফে নেন সালাহ।

কিন্তু সে পথ যে অনেক বন্ধুর! তার বাড়ি থেকে সেই জায়গার দুরত্ব দুই শ' মাইল। স্বপ্ন পূরণ করতে সেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন কিশোর সালাহ। কখনো বাবার সাথে, কখনো বা একা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও হাল ছাড়েননি তিনি। তার অদম্য মানসিকতার কারণে ক্লাবটি তাকে হাতছাড়া করেনি। ভিড়িয়ে নেয় দলে। যার যথাযথ মূল্যও দিয়েছেন সালাহ। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে চমক দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি। রাতের ঘুম হারাম করছেন এতোদিন ফুটবলবিশ্ব রাজত্ব করা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোদের।

ব্যক্তিগত জীবন : ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিয়ে করেন সালাহ। স্ত্রী ম্যাগির জন্মও মিসরে। দু'জন একই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তখন থেকেই পরিচয়। এরপর বিয়ে। তবে সালাহ অন্য সব তারকাদের মতো বিয়ের সময় কোনো রাখ-ঢাকা রাখেননি। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন পুরো গ্রামের মানুষদের। হাজার হাজার মানুষ সেদিন সালাহর বিয়ের দাওয়াত খেয়েছেন।

সালাহর একমাত্র কন্যার জন্ম হয় ২০১৪ সালে। লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করে সালাহ'র রাজকন্যা 'মক্কা'। সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কার নাম অনুসারে রাখা হয় কন্যার নাম। স্ত্রী ম্যাগিই প্রথম সালাহকে এই নাম রাখার কথা বলেন। পরে সালাহ মেয়ের নাম রাখেন মক্কা।

সালাহর জীবন-যাপন অন্য সব তারকাদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি কিছুদিন পর পর চুলের স্টাইল পাল্টান না। আসলে তিনি চুলে বিশেষ কোনো স্টাইলও করেন না। রাতে পার্টি করেন না। গায়ে কোনো ট্যাটুও আঁকান না তিনি। সংবাদ মাধ্যম থেকেও দুরে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তেমন সরব নন। প্রচার বিমুখ বলা যায়। স্ত্রী ম্যাগীও তার মতো। তিনিও প্রচারের বাইরে থাকেন। লাজুক প্রকৃতির। বিয়ের ছাড়া তার অন্য কোনো ছবি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তবে ম্যাগী এবং সালাহ দু'জনেই রাজকন্যা 'মক্কা'র ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। একেবারে সাদা মাটা জীবন-যাপন সালাহর। এতো সাধারণের মাঝেও অসাধারণ সালাহ।

ধার্মিক : সালাহর হাতে প্রায় সময়ই পবিত্র কোরআর শরীফ দেখা যায়। বিমানে ভ্রমণের সময়ও তিনি নিয়মিত কোরআন শরীফ তেলোয়াত করেন। নিয়মিত নামাজ পড়েন। এমনকি খেলার দিন মাঠে প্রবেশের আগে ওজু করে নেন এই মিসরীয় ফুটবলার। প্রতি গোলের পরই মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। সেজদাহও করেন। মাঠে তার এই ধর্ম পালন কারো কাছে অস্বাভাবিক 
নয়। তার খেলা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। লিভারপুলের মুসলিম খেলেয়াড়রাও তার ভক্ত হয়ে গেছেন। অথচ এই ক্লাবের সমর্থকরাই চাননি সালাহকে ক্লাবে নেয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন। সব আপত্তি উপেক্ষা করে সালাহকে ক্লাবে নিয়েছেন লিবারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপ। তিনি যে কতটা সঠিক ছিলেন তার প্রমাণ এখন সালাহর জনপ্রিয়তা। তিনি খেলা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন।

মহানুভব : নিজ শহর নাগরিগে অনেক জনপ্রিয় সালাহ। এর কারণ শুধু তার খেলাই নয়, তার মহানুভবতা। সব সময় তার কাছে আগে তার শহর, তারপর বাকি সব। যখন থেকে উপার্জন করা শুরু করেছেন শহরের বাসিন্দাদের জন্য দুই হাতে খরচ করেন। এলাকার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। সেখানে একটি জিম বানিয়েছেন নিজের নামে। তবে সেটি উন্মুক্ত সবার জন্য।

তারকা হওয়ার পরও তার আচরণে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই এলাকায় এসে শিশুদের সাথে ফুটবল খেলেন। পুল খেলেন, টেবিল টেনিস খেলেন।

নিজের স্কুল আইয়াদ আল তানতাওয়েতে ফুটবল খেলার জন্য পিচ বানিয়ে দিয়েছেন তিনি। যারা টাকার অভাবে বিয়ে করতে পারছেন না, তাদের অর্থ সাহায্য দিয়েছেন।

এছাড়া কায়রোর একটি হাসাপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের জন্য ছয় লাখ ডলার দান করেছেন সালাহ।

সালাহর মহানুভবতার এমন অনেক গল্প রয়েছে এলাকাবাসীর কাছে। এই তো কয়েক মাস আগে পেনাল্টি থেকে গোল করে মিসরকে বিশ্বকাপের টিকেট পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এ ঘটনার পর দিন দেশটির শীর্ষ ক্লাব জামালেকের সাবেক সভাপতি সালাহকে খুশি হয়ে একটি ভিলা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা নিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এর পরিবর্তে শহরের বাসিন্দাদের জন্য সাহায্য চান সালাহ।

তার মহানুভবতার আরো একটি মজার ঘটনা রয়েছে। একবার সালাহর বাড়িতে বড় ধরণের চুরি হয়। তার বাবা মামলা করেন। পরে ওই চোরকে পুলিশ আটক করে। সালাহ সে খবর শুনে চোরকে ছাড়িয়ে আনেন। শুধু তাই নয়, চোরকে আর্থিক সাহায্য করেন। এবং পরামর্শ দেন, যাতে আর চুরি না করেন।

তারকাখ্যাতি পেয়েও শেকড়কে ভুলে যাননি সালাহ। প্রতি রমজান মাসে শহরে আসেন তিনি। শুধু আসেন বললে ভুল হবে, সব শিশুদের জন্য হাতভরে উপহার নিয়ে আসেন। সালাহর বন্ধু মোহাম্মদ বাসিওয়ানি বলেন, 'তারকা হয়েও এতটুকু বদলে যায়নি সালাহ। সে সবাইকে অটোগ্রাফ দেয়। সবার সাথে ছবি তুলে। কাউকে নিরাশ করে না।'

শহরে সালাহর প্রিয় জায়গা হলো তার বন্ধু বাসিওয়ানির ক্যাফেটি। এই ক্যাফের একদিকের দেয়ালে বিশাল একটি টিভিস্ক্রিন। সেখানে সারাদিনই চলতে থাকে ফুটবল ম্যাচ। সালাহ নাগরিগে এলে বেশিরভাগ সময় কাটে এই ক্যাফেতে।

ক্যারিয়ার : পেশাদার ফুটবলার হিসেবে সালাহ তার ক্যারিয়ার শুরু করেন মকোলুন নামক একটি ক্লাবের হয়ে। পরে ২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহর ভিত্তিক ক্লাব এফসি বাসেল এ স্থানান্তরিত হন। এরপর জনপ্রিয় ব্রিটিশ ক্লাব চেলসি, ইটালীয় ক্লাব ফিওরেন্টিনা (ধারে) এবং রোমার হয়ে খেলেন। ২০১৭ সালে রোমা থেকে জনপ্রিয় ক্লাব লিভারপুলে নাম লেখান।

ক্লাবের হয়ে খেলার পাশাপাশি তিনি ২০১১ সাল থেকে মিসরের জাতীয় ফুটবল দলের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। তিনি আফ্রিকা অনুর্ধ-২০ কাপ অব নেশনসে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন। এছাড়াও ২০১১ সালে কলাম্বিয়ায় আয়োজিত ২০১১ ফিফা অনুর্ধ-২০ বিশ্বকাপেও অংশগ্রহণ করেছেন। পরের বছর লন্ডনে অনুষ্ঠেও সামার অলিম্পিকস, লিবিয়াতে অনুষ্ঠেও সিএএফ কাপ অব নেশনস ২০১৭ অংশগ্রহণ করেছেন, এবং তার দল ফাইনালেও পৌছে যায়। তবে ফাইনাল ম্যাচটি আর জেতা হয়নি তাদের। এর পর রাশিয়া বিশ্বকাপে জাতীয় দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। এছাড়া ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলার জন্য যোগ্যতা অর্জনকারী ফিফা বিশ্বকাপ কোয়ালিফিকেশনে (সাফ) সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। এ পর্যন্ত দেশের হয়ে ৫৬ ম্যাচে ৩২ গোল করেছেন সালাহ।

সালাহ তার ক্লাব বাসেলের সাথে প্রথম সিজনেই সুইস সুপার লিগ এবং ২০১৪-১৫ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ জয় করেন। এছাড়া চেলসির সাথে ২০১৪-১৫ মৌসুমের ফুটবল লিগ কাপ জয় করেন। ২০১২ সালে তিনি প্রতিশ্রুতিশীল আফ্রিকান প্রতিভার পুরস্কার পান। পরের বছর ২০১৩ সালে, সুইস সুপার লিগে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য, তাকে এসএফপি গোল্ডেন প্লেয়ার অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দেয়া হয়।

২০১৭ সালে সাফ বছরের সেরা আফ্রিকান ফুটবলার হিসেবেও সালাহর নাম ঘোষণা করে। এছাড়া একই বছরের নভেম্বরে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন তিনি।

চলতি বছরও হয়েছেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা খেলোয়াড়। চলতি মৌসুমে লিভারপুলের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৫১ ম্যাচে সালাহ করেছেন ৪৪ গোল। জিতেছেন প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ইংলিশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের এক মৌসুমে তিনবার ‘প্লেয়ার অব দ্য মান্থ’য়ের পুরস্কার।

সম্প্রতি ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন সালাহ। এছাড়া প্রফেশনাল ফুটবলার অ্যাসোসিয়েশনের (পিএফএ) সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

আছে আরো অর্জন। প্রিমিয়ার লিগের চলতি মৌসুমে গোলের নতুন রেকর্ড গড়েছেন সালাহ। ৩৮ ম্যাচে রেকর্ড ৩২ গোল করে তিনি লীগে সর্বোচ্চ গোলের নতুন রেকর্ড গড়েছেন। এর সুবাদে হয়েছেন গোল্ডেন বুটের মালিক।

ভবিষ্যতে এই মুসলিম ফুটবলার ব্যালন ডি'অরের জন্য লড়বেন লিওনেল মেসি ও রোনালদোদের সাথে। যদি এই দুই মহাতারকাকে হটিয়ে তার হাতে উঠে ব্যালন ডি'অর তার হাতে উঠে তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।


আরো সংবাদ



premium cement