২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৪

হিংসার আগুনে মৃত্যু উপত্যকা দিল্লি

আগেই সতর্ক করেছিল গোয়েন্দারা; নিহতদের ধর্মীয় পরিচয় গোপনের চেষ্টা; দিল্লিতে মসজিদে আগুন দেয় পুলিশ; লাগামহীন সহিংসতার টার্গেট মুসলিমরাই : মার্কিন কমিশন; মার্কিন রাজনীতিকদের গভীর উদ্বেগ
দিল্লিতে নিহত মোহাম্মদ মুদাস্সিরের লাশের পাশে স্বজনরা (বাঁয়ে); নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন মুসলমানরা। দিল্লির খাজুরি খাস এলাকা থেকে তোলা : এএফপি/পিটিআই -

ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে নিহতের সংখ্যা ৩৪ জন পৌঁছেছে। আহত হয়েছে দুই শতাধিক। টানা চার দিন চলতে থাকা দফায় দফায় সংঘর্ষে থমথমে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দিল্লির ভজনপুরা, মৌজপুর, ব্রহ্মপুরী, গোকুলপুরী ও কারাওয়ালনগরে। সব স্থানেই দেখা মিলছে অগ্নিকাণ্ডে পোড়া ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মসজিদের দৃশ্য। এ অবস্থায় এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে মুসলিম পরিবারগুলো।
ঘটনা শুরুর চার দিন পর গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব’ বজায় রাখতে সবার কাছে অনুরোধ জানান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বৈঠক করেছেন দফায় দফায়। এ সহিংসতায় ১৮টি এফআইআর করেছে দিল্লি পুলিশ। ১৩০ জনকে গ্রেফতার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করছে তারা। গত বুধবার শহরের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। দিল্লি প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
গত বুধবার রাতে দিল্লি হাইকোর্ট উসকানিমূলক ভাষণ দেয়ার কারণে বিজেপির চার নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, স্থানীয় নেতা কপিল মিশ্রের মতো লোকেরাও। তবে এ ব্যাপারে কোনো এফআইআর দায়ের না করে দিল্লি পুলিশ আদালতে জানিয়ে দেয়, দিল্লির যা পরিস্থিতি তাতে এখনই এফআইআর করলে, তা শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হবে না।
এই পরিস্থিতিতে টানা দ্বিতীয় দিনের জন্য সিবিএসই বোর্ডের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের সময় অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই এই সংঘর্ষ চালানো হয়েছে। তবে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সহিংসতার জন্য ভারত প্রশাসনকেই দায়ী করা হয়েছে। এমনকি দিল্লিতে মসজিদে আগুন লাগানোর পেছনে পুলিশের হাত রয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা। সব মিলিয়ে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খবর বিবিসি, রয়টার্স, এনডিটিভি, আনন্দবাজারের।
পালাচ্ছেন মুসলমানরা : দিল্লিতে টানা সহিংসতার ঘটনার পর খাজুরি খাস, মৌজপুর, বাবরপুর, ভাগীরথী বিহারের মুসলিম এলাকাগুলো খাঁ খাঁ করছে। খাজুরি খাস এলাকায় গত মঙ্গলবার গভীর রাতে হাজারখানেক যুবক প্রবেশ করে, যাদের মুখে ছিল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি এবং হাতে বন্দুক, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র। এলাকাতে ঢুকেই তারা মারধর শুরু করে সেখানকার বাসিন্দাদের। ঘরে ঘরে ঢুকে শুরু করে লুটপাট। তারপর একটা একটা করে বাড়িতে আগুন লাগাতে থাকে। আগুন দেখে সেখানকার বাসিন্দারা কোনো মতে পালিয়ে বাঁচেন। পরের দিন দেখা যায়, পুরো মহল্লাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মুসলমানদের লক্ষ্য করে চালানো এ হামলায় হিন্দুদের বাড়িও পুড়েছে। কোনো মুসলিম পরিবার আর সেখানে নেই। প্রাণ বাঁচাতে সবাই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দুঃখ প্রকাশ : সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে (সিএএ) কেন্দ্র করে ভারতের দিল্লিতে চলমান সহিংসতায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানায় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম। এক সংবাদ সম্মেলনে ডুজারিক জানান, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সহিংসতা রোধে সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযমের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতি মহাসচিবের সমর্থনের কথা জানিয়ে স্টিফেন ডুজারিক জানান, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
মানুষের সমাধির ওপর আধুনিক দিল্লি নয় : কেজরিওয়াল
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, ‘মানুষের সমাধির ওপর আধুনিক দিল্লি গড়ে উঠতে পারে না।’ চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, এ দাঙ্গায় কার লাভ হলো? দিল্লিবাসী হিংসা আর সংঘর্ষ চান না। আম আদমি নয়, কয়েকজন সমাজবিরোধী, রাজনৈতিক ব্যক্তি এ ঘটনার সাথে জড়িত। দিল্লির হিন্দু-মুসলিমরা কখনই এসব চান না। সব ধর্মের মানুষের কাছে অনুরোধ জানিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের ঘৃণার রাজনীতি বর্জন করতে সব ধর্মের মানুষ এগিয়ে আসুন। আমরা ঘৃণা ও দাঙ্গার রাজনীতি বরদাশত করব না।
অস্ত্রশস্ত্র আসে যোগীরাজ্য থেকে : দিল্লির গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতাল এবং জল প্রবেশ চন্দ্র হাসপাতাল জানিয়েছে, দিল্লির সংঘর্ষে যারা নিহত হয়েছেন অথবা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের শরীরে বুলেট, ধারালো ব্লেড, পাথর, ভোঁতা বস্তু ও পোড়ার ক্ষত রয়েছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ জনের শরীরে বুলেটের আঘাত পাওয়া গেছে। আহতদের ৪৬ জনের শরীরেও পাওয়া গেছে বুলেটের চিহ্ন।
হাসপাতাল সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা গেছে, হামলায় জড়িতরা নানারকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। হামলায় দেশী পিস্তল, তলোয়ার, হাতুড়ি, কাঁচি, বেসবল ব্যাট, লাঠি ও বড় পাথর ব্যবহার করা হয়। পুলিশ ধারণা করছে, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে হামলায় ব্যবহৃত দেশী পিস্তলগুলো দিল্লিতে ঢোকে। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের শামলি ও মুজাফফরনগর থেকে এসব অস্ত্রের পাশাপাশি অনেক হামলাকারীও দিল্লিতে আসে।
এ কারণে গত রোববারেই বন্ধ করে দেয়া হয় দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমান্তের কিছুটা অংশ। আর মঙ্গলবার পুরোপুরি সিল করে দেয়া হয় দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ সীমানা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্মী মন্তব্য করেন যেহেতু দিল্লিতে কোনো অস্ত্রের কারখানা নেই, তাই প্রথম দিনেই যদি সীমানা সিল করে দেয়া যেত, তা হলে সহিংসতা এত বড় রূপ ধারণ করতে পারত না।
আগেই সতর্ক করেছিল গোয়েন্দারা : দিল্লির পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল ভারতীয় পুলিশ। গত রোববার তাদের কাছে ছয় দফা সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগ। নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরও পুলিশি ব্যর্থতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রোববার বেলা ১টা ২২ মিনিটে টুইট করে সিএএ-এর সমর্থনে ওই দিন বেলা ৩টায় দিল্লির মৌজপুর চক এলাকায় সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন বিতর্কিত বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র। এই টুইটের ঠিক পরেই প্রথম সতর্কবার্তাটি পাঠিয়ে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করার কথা বলা হয় দিল্লি পুলিশকে। এরপর সময় গড়ানোর সাথে আরো কয়েক দফা স্থানীয় পুলিশকে নজরদারি বাড়ানোর কথা বলেছিল গোয়েন্দা দফতর। কিন্তু এসব সতর্কবার্তায় তেমন সাড়া দেয়নি পুলিশ। সে দিন সন্ধ্যাতেই সহিংসতা শুরু হয়, যা পরের দিন ভয়াবহ রূপ নেয়।
৮৫ বছরের বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে হত্যা : দুপুরে দুধ কিনতে বেরিয়ে মোহাম্মদ সাঈদ সালমানি খবর পেয়েছিলেন, তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। শ’খানেক সশস্ত্র লোক তছনছ করে ফেলছে তার পাড়া। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর জ্বলন্ত তিনতলা বাড়ি থেকে সবাই ছুটে বেরিয়ে গেলেও নড়তে পারেননি সালমানির ৮৫ বছর বয়সী মা আকবরি। ফিরে সালমানি আর্তনাদ, আহাজারি আর হাহাকার করছেন, ‘আমার বৃদ্ধ মা বের হতে পারলেন না। আমি থাকলে মাকে ছাদে নিয়ে যেতাম।’ গতকাল বৃহস্পতিবার ওই মায়ের লাশ দাফন করা হয়।
মধ্যরাতেই দিল্লির ‘রক্ষাকর্তা’ সেই বিচারপতির বদলি : দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলিধরকে গত সপ্তাহেই পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করেছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম। সেই বদলির প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করে দিল্লি হাইকোর্টের আইনজীবীরা। দিল্লি হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ‘দ্ব্যর্থহীন এবং যথাসম্ভব কড়া ভাষায়’ বদলির সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলে, এর ফলে প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে বিচারপতি মুরলিধরের ভূমিকা দেখার পরে সেই আইনজীবীরাই বলছিলেন, কার্যত দিল্লির মানুষের ‘রক্ষাকর্তা’ হয়ে উঠলেন তিনি। ঘটনাচক্রে কলেজিয়ামের সুপারিশ মেনে বুধবার রাতেই বিচারপতি মুরলিধরকে বদলি করে দিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। বুধবার মাঝরাতে এ-সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়।
উত্তর-পূর্ব দিল্লির মুস্তাফাবাদে সংঘর্ষে আহত লোক বহু স্থানীয় ছোট একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের এলাকার বাইরে এনে বড় হাসপাতালে ভর্তি করা যায়নি। পুলিশের কোনো সাহায্য না পেয়ে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার সময় বিচারপতি মুরলিধরের বাড়িতে যান চিকিৎসক ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের আর্জি শুনতে রাজি হন বিচারপতি মুরলিধর। রাত পৌনে ২টার সময় দিল্লি পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা মানুষের কাছে পৌঁছে ভরসা তৈরির সময়।’ বুধবার দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে মামলার শুনানির সময় সহিংসতার জেরে ঘরছাড়া মানুষের জন্য উপযুক্ত আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করারও নির্দেশ দেন তিনি।
বিচারপতি বদলির কড়া সমালোচনা রাহুল-প্রিয়াঙ্কার : দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলিধরের বদলি নিয়ে শুরু হয়েছে শাসক ও বিরোধী পক্ষের বিতণ্ডা। দিল্লির সাম্প্রতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মুরলিধর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং হিংসায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে, সেসব নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর করার বিষয়ে কেন্দ্রকে চিন্তাভাবনা করতে বলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই রাতারাতি বদলির নির্দেশ কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধী পক্ষের নেতারা।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এ দিন বিচারপতি মুরলিধরের বদলির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করে টুইট করেন। রাহুলের এই টুইটের পরই ময়দানে নেমে পড়ে বিজেপি। বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, মুরলিধরের বদলি কার্যত রুটিন বদলি। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী তার টুইটে লিখেছেন, মধ্যরাতে বিচারপতি মুরলিধরের এই বদলির নির্দেশ বর্তমান পরিস্থিতিতে মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বেদনাদায়ক ও লজ্জাকর।
‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কারে মুসলিমদের বাড়িতে হামলা : জাফরাবাদের মেট্রো স্টেশনের কাছে মুস্তাফাবাদ এলাকায় একটি বাড়ির বৈঠকখানায় কয়েক শ’ মুসলিম, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক, অবিশ্বাস। সেখানে মাঝবয়সী এক নারী জানান, কোথা থেকে হঠাৎ করে ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার দিয়ে শত শত দুষ্কৃতকারী মুসলমানদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। তারা চিৎকার করছিল, মুসলমানদের খতম করে দেবো। বাঁচতে দেবো না। তারা বলছিল, পুলিশ তাদের কিছুই করতে পারবে না। এ অভিযোগ সেখানকার অসংখ্য মানুষের। মুস্তাফাবাদের বাসিন্দারা জানান, এলাকার ফারুকিয়া মসজিদ ও মিনা মসজিদে যখন হামলা হচ্ছিল, তখন সামনেই পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বাধা দেয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি।
সরকারকে ‘রাজধর্ম’ পালন করতে বলুন : সোনিয়া
দিল্লি-হিংসায় গত পাঁচ দিনে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটেছে, আর বিজেপি-আপ ‘নীরব দর্শকের’ ভূমিকা পালন করছে, রাষ্ট্রপতির দরবারে হাজির হয়ে তাই তাদের ‘রাজধর্ম’ পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানালেন কংগ্রেসের অন্তর্র্বর্তী সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। পাশাপাশি হিংসা সামলানোয় ‘ব্যর্থ’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগও দাবি করেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ভবনে রামনাথ কোবিন্দের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল কংগ্রেসের প্রতিনিধিদল। সেই দলে আরো ছিলেন মনমোহন সিংহ, পি চিদাম্বরম, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতারা।
দিল্লিতে বাড়তে থাকা হিংসায় উদ্বিগ্ন কংগ্রেস, রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছে। এতে লেখা রয়েছেÑ রাষ্ট্রপতি, সরকারের বিবেককে রক্ষা করা এবং সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য ভারতীয় সংবিধানে আপনাকেই সর্বোচ্চ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
লাগামহীন সহিংসতার টার্গেট মুসলিমরা : মার্কিন কমিশন
ভারত সফরে থাকাকালীন দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তিনি ফিরে যেতেই গোটা ঘটনায় ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক মার্কিন কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)। তাদের অভিযোগ, বেছে বেছে মুসলিমদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। অথচ সব দেখেশুনেও নীরব ভারত সরকার। নৃশংস ও লাগামছাড়া সহিংসতা রুখে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ তারা। তবে মার্কিন ওই সংগঠনের মন্তব্যের জবাবে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রবিশ কুমার টুইটারে বলেন, ইউএসসিআইআরএফের অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়, বরং বিভ্রান্তিমূলক। বরং মনে হচ্ছে, বিষয়টির রাজনীতিকরণই ওদের উদ্দেশ্য। সহিংসতা রুখে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা আমাদের সংস্থাগুলো। সরকারের শীর্ষস্তরের প্রতিনিধিরা বিষয়টি তদারকি করছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে শান্তি এবং সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আর্জি জানিয়েছেন। এমন সংবেদনশীল সময়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো মন্তব্য না করতে অনুরোধ জানাচ্ছি আমরা।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে দেশজুড়ে সিএএ বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন এই অশান্তি দানা বেঁধেছে উল্লেখ করে ইউএসসিআইআরএফের কমিশনার অনুরিমা ভার্গব বলেন, দিল্লিজুড়ে যে নৃশংস এবং লাগামছাড়া সহিংসতা বেড়ে চলেছে, তা চলতে দেয়া যায় না। সব নাগরিককে নিরাপত্তা দিতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া উচিত ভারত সরকারের। অথচ তার বদলে খবর আসছে, মুসলিমদের ওপর হিংসাত্মক হামলা রুখতে কোনো ভূমিকাই নেয়নি দিল্লি পুলিশ। নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। যে মুহূর্তে ভারতে বেছে বেছে মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে, তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চলছে, ঠিক সেই সময় এ ধরনের ঘটনা খুবই উদ্বেগের।
ইউএসসিআইআরএফের চেয়ারপারসন টোনি পারকিন্স বলেন, দিল্লিতে যে সহিংসতা চলছে, যেভাবে মুসলিমদের ওপর হামলা এবং তাদের বাড়ি, দোকান ও ধর্মীয় স্থান জ্বালিয়ে দেয়ার খবর আসছে, তা উদ্বেগের। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়াই দায়িত্বশীল সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। তাই মুসলিমদের এবং যারা যারা হামলার শিকার হয়েছেন তাদের সবার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে আর্জি জানাচ্ছি আমরা।
নিহতদের ধর্মীয় পরিচয় গোপনের চেষ্টা : দিল্লিতে সহিংসতায় নিহতদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে লুকোচুরি খেলছে প্রশাসন। নিহতদের লাশও পরিবারের কাছে ঠিকভাবে হস্তান্তর করছে না তারা। এমনকি গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতাল নিহতদের নাম-ধাম পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমকে জানাতে সরাসরি অস্বীকার করেছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে ছয়জন হিন্দু রয়েছে। কিন্তু প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো খবর পাওয়া যায়নি। প্রশাসনের নীরবতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য সামনে আসতে দিতে রাজি নয়।
পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মুসলিমদের এই প্রাণহানিও প্রমাণ করছে তারা একটা পরিকল্পিত সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছে। মুসলিম মহল্লাগুলোতে বেছে বেছে মসজিদ মাদরাসা বা কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়েছে।
দিল্লিতে মসজিদে আগুন দেয় পুলিশ : দিল্লিতে কমপক্ষে তিনটি মসজিদে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। অন্য দিকে বহু বাড়িঘর ও দোকানপাটেও হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ দিকে দিল্লির সহিংসতায় দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সহিংসতা বন্ধের চেষ্টা না করে উন্মত্ত জনতার সাথে যোগ দিয়ে জয় শ্রীরাম বলে স্লোগান দিচ্ছিল পুলিশ। একই সাথে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা।
ফারুকিয়া নামের একটি ছোট মসজিদের দেখাশোনা করেন মোহাম্মদ আব্বাস (৮৫)। তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকেলে নামাজের পর একদল পুলিশ কর্মকর্তা মসজিদের ইমাম এবং তার ওপর হামলা চালায়। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা তাকে দেশদ্রোহী বলে গালাগালি দিচ্ছিল। তার চোখের সামনেই ওই পুলিশ সদস্যরা মসজিদ ভাঙচুর করেছে এবং আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এর পরই সেখান থেকে মোহাম্মদ আব্বাসকে একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল। তিনি বলেন, তারা আমাকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। তবে পুলিশের মুখপাত্র রান্ধওয়া এ ঘটনা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনার প্রমাণ পেলে প্রশাসন অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
দিল্লিতে মার্কিনিদের সতর্কবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফর করে দেশে ফেরার পরই দিল্লিতে নিজ দেশের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে মার্কিন সরকার। গত বুধবার একটি নির্দেশিকা জারি করে ভারতে থাকা মার্কিনিদের ‘উত্তেজনাপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে চলতে’ বলেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এর আগে ভারতে অবস্থান করার সময়ে ট্রাম্পকে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং দিল্লির সংঘর্ষ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টিকে ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলেই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প মুখে একথা বললেও হোয়াইট হাউজ যে দিল্লির অস্থিরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাই স্পষ্ট হল তার দেশে ফেরার পর মার্কিন নাগরিকদেরকে দেয়া ওই সতর্কবার্তায়।
মার্কিন রাজনীতিকদের গভীর উদ্বেগ : দিল্লির সহিংসতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি বলেন, ভারত সফরকালে দিল্লির সহিংসতা নিয়ে ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন তা হলো নেতৃত্বের ব্যর্থতা। তিনি মানবাধিকার ইস্যুতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বুধবার এক টুইটে বার্নি স্যান্ডার্স লিখেছেন, কমপক্ষে ২০ কোটি মুসলিমের বসবাস ভারতে। তারা একে তাদের দেশ মনে করেন। মুসলিমবিরোধী ভয়াবহ দাঙ্গায় সেখানে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি ভারতের বিষয়’। এর সমালোচনা করে স্যান্ডার্স আরো লিখেছেন, মানবাধিকার ইস্যুতে এটা হলো নেতৃত্বের ব্যর্থতা।
এর আগে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন একই দলের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন। ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থীর ছাড়াও অন্য প্রভাবশালী সিনেটররা বুধবার দিল্লির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সিনেটর মার্ক ওয়ার্নার এবং রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর জন করনিন একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন এ নিয়ে। ওয়ার্নার ও করনিন হলেন সিনেটে ইন্ডিয়া ককাসের কো-চেয়ার। এটা হলো মার্কিন সিনেটে সবচেয়ে বড় ককাস।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement