২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন ফের খারিজ

-

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার (অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট) জন্য মানবিক কারণে জামিন চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণ করে জামিন আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন।
আদেশে আদালত বলেন, খালেদা জিয়া একজন বন্দী ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সাধারণ একজন মানুষ এবং একজন দণ্ডপ্রাপ্তের সুযোগ-সুবিধা এক নয়। তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই (বিএসএমএমইউ) তার চিকিৎসা হতে পারে। আমরা এই আবেদনে জামিনের নতুন কোনো কারণ দেখছি না। জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো। তবে তিনি উন্নত চিকিৎসার (অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট) জন্য সম্মতি দিলে তা হতে পারে। তিনি সম্মতি দিলে মেডিক্যাল বোর্ডকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে বলেছেন আদালত। আর মেডিক্যাল বোর্ড চাইলে নতুন চিকিৎসক অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়াতে পারবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।
আদালত বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া তার চিকিৎসার জন্য সম্মতি দেননি। যেহেতু খালেদা জিয়া তার চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত সম্মতি দেননি তাই উন্নত চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। আদালত আরো বলেন, দেশের সর্বোচ্চ হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র বিএসএমএমইউ। দেশে যত হাসপাতাল আছে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীদের এখানে পাঠানো হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই যে, এই বোর্ড খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দিতে অক্ষম বা এ কথাও উল্লেখ করা নেই বিএসএমএমইউতে এ ধরনের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি একজন বন্দী। তিনি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে, একজন বন্দী তা পারবেন না। কারাবিধি ও নিয়মনীতি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে।
আদেশের আগে খালেদা জিয়ার পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি নতুন ধরনের অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট গ্রহণ করার জন্য যেখানে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সুযোগ যাতে পান সে জন্য মানবিক কারণে জামিন প্রার্থনা করেন। জয়নুল আবেদীন বলেন, মানবিক কারণে আমরা তার জামিন আবেদন নিয়ে এসেছি, আমরা বার বার আসতে পারি। খালেদা জিয়ার অবস্থার অবনতি হলে আমরা তো আদালতেই আসব। তিনি ইতোমধ্যেই দুই বছর সাজা খেটেছেন। তিনি যাতে উন্নততর চিকিৎসা নিতে পারেন সে জন্য আমরা মানবিক কারণে জামিন চাচ্ছি।
শুনানিতে খালেদা জিয়ার জামিন প্রার্থনা করে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, কোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা তখনই রোগীর সম্মতি চান যখন ওই চিকিৎসায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তার ক্ষেত্রে যে অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের কথা বলা হয়েছে সেখানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে বলে মেডিক্যাল বোর্ড উল্লেখ করেছে। খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা নেন। জেল কোডে আছে একজন আসামি যে ধরনের চিকিৎসা নেন তাকে সেই চিকিৎসা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি যে ধরনের জীবনযাপন করতেন সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া যেখানে চিকিৎসা নিতেন সেখানে যাতে চিকিৎসা নিতে পারেন সেই সুযোগ দেয়ার জন্য তার জামিন প্রার্থনা করছি।
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, উন্নত চিকিৎসা বা অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের সম্মতি দেননি বেগম খালেদা জিয়া। তিনি উন্নত চিকিৎসার টেস্টই করতে দেননি। তিনি বলেন, ওষুধে লেখা থাকে কী সাইড ইফেক্ট থাকতে পারে। এই উন্নত চিকিৎসায় কোনো সাইড ইফেক্ট হবে না। তিনি বলেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে এই জামিন আবেদন করা হয়েছে।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে আরো উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, সগীর হোসেন লিওন প্রমুখ। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো: খুরশীদ আলম খান।
জামিন আবেদনের শুনানির সময় আদালতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিএনপির রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এবং গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
আদালতের আদেশের পর জয়নুল আবেদীন বলেন, আমরা বলেছি বেগম খালেদা জিয়ার জীবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার চিকিৎসা যেখানে অপারেশন হয়েছে সেখানে হওয়া দরকার। সেটা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। আমাদের বক্তব্য শুনে আদালত আবেদন খারিজ করেছেন। এই আদেশে আমরা ক্ষুব্ধ। আমরা মনে করি মানবিক কারণে এই জামিন আবেদন বিবেচনা করা উচিত ছিল।
স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন : গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অ্যাডভান্স (উন্নত) ট্রিটমেন্টের জন্য খালেদা জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কি না, সম্মতি দিলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কি না এবং শুরু হলে কী অবস্থা তা জানাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে পাঠাতে বলা হয়। এ বিষয়ে আদেশের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার দিন রাখেন হাইকোর্ট।
ওই আদেশ অনুসারে বুধবার বিএসএমএমইউ থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো: আলী আকবার। এরপর আদালত এ প্রতিবেদন পড়ে শোনান। প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট নিতে খালেদা জিয়া রাজি হননি।
এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে সকালে আদালত আদেশ দিতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন রোববার পর্যন্ত সময় চান। কিন্তু আদালত তাতে রাজি না হলে তিনি (জয়নুল আবেদীন) এ দিন বেলা ২টা পর্যন্ত সময় দেয়ার আবেদন জানান। এরপর আদালত বেলা ২টায় আদেশের জন্য সময় রাখেন। বেলা ২টার পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দুটি সম্পূরক আবেদন দেন। এরপর উভয়পক্ষ শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন।
আইনজীবীদের বিক্ষোভ : খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর এ আইনজীবীরা আদালত থেকে বের হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এতে শতাধিক আইনজীবী অংশ নেন। মিছিলটি এনেক্স ভবন থেকে শুরু হয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এসে শেষ হয়। বিক্ষোভ মিছিলে খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে বিভিন্ন সেøাগান দেয়া হয়। বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়ে আইনজীবীরা ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’, ‘আদালত না রাজপথ রাজপথ’, এসব সেøাগান দেন। এতে আরো অংশ নেন ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, আইনজীবী আবেদ রাজা, রুহুল কুদ্দুস কাজল, মো: আক্তারুজ্জামান, এবিএম রফিকুল হক তালুকদার রাজা, শাহ আহমেদ বাদল, মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, গোলাম আকতার জাকির প্রমুখ।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন উপস্থাপন করা হয়। আবেদনে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে তার উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে না। জামিন পেলে তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান। আবেদনকারীর (খালেদা জিয়ার) শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না, খেতে পারছেন না। এমনকি ওষুধও নিতে পারছেন না। তাই দ্রুত তাকে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশে নিয়ে আধুনিক, উন্নত চিকিৎসা বা থেরাপি দেয়ার প্রয়োজন। তার এই অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক উন্নত থেরাপি বা চিকিৎসার স্বার্থে নতুন করে এই জামিন আবেদনটি করা হয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এর আগে গত ৩১ জুলাই এ মামলায় হাইকোর্ট জামিন আবেদন খারিজ করেন। গত বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ চার আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০১০ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করে দুদক।

 


আরো সংবাদ



premium cement