২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
বিদ্যুৎ-পানির দাম ফের বাড়ল

৮ শতাংশ বাড়ল বিদ্যুতের

পাইকারি ৮.৪ শতাংশ, গ্রাহক ও সঞ্চালনে ৫.৩ শতাংশ বৃদ্ধি; জনগণের পকেট থেকে অতিরিক্ত দিতে হবে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা; কার্যকর ১ মার্চ থেকে
-

ব্যবসায়ী, সাধারণ ভোক্তা, রাজনীতিবিদসহ সব শ্রেণীর গ্রাহকের বিরোধিতাকে বিবেচনায় না নিয়ে আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এবার গ্রাহকপর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আর পাইকারিতে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ ও সঞ্চালন চার্জ বাড়ানো হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এতে আগামী মাস থেকেই গ্রাহককে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হবে ছয় টাকা ৭৭ পয়সার পরিবর্তে সাত টাকা ১৩ পয়সা করে। আর পাইকারি গ্রাহক অর্থাৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে গড়ে প্রতি ইউনিটের দাম চার টাকা ৭৭ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা ৭৭ পয়সা পরিশোধ করতে হবে। সব মিলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে গ্রাহকের পকেট থেকে বাড়তি দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।
গতকাল অষ্টমবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কারওয়ান বাজারে বিইআরসির কার্যালয়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান মো: আব্দুল জলিল। এ সময় বিইআরসির সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
গ্রাহকভেদে বিদ্যুতের বর্ধিত দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে বিইআরসি চেয়ারম্যান জানান, আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ও গ্রাহকের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের দাম আনুপাতিক হারে কম বাড়িয়েছি। বিইআরসি জানায়, বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধির ফলে একজন সাধারণ গ্রাহককে আগে যেখানে ২১৫ টাকা থেকে ২১৯ টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন তাদের পরিশোধ করতে হবে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা। নিম্নবিত্তদের মাসে গড়ে বাড়তি পরিশোধ করতে হবে ৫৬ টাকা। আগে যেখানে ৭৫৯ টাকা পরিশোধ করতে হতো, আগামী মাস থেকে পরিশোধ করতে হবে ৮০৩ টাকা। মধ্যবিত্তদের মাসে গড়ে বাড়তি পরিশোধ করতে হবে ১০৭ টাকা। আগে যেখানে পরিশোধ করতে হতো এক হাজার ৯৫২ টাকা, আগামী মাস থেকে তা পরিশোধ করতে হবে দুই হাজার ৬৬ টাকা। সেচকাজে প্রতি মাসে গড়ে বাড়তি পরিশোধ করতে হবে ১৮৮ টাকা। আগে যেখানে তিন হাজার ২৬০ টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন তা পরিশোধ করতে হবে তিন হাজার ৪৪৮ টাকা। তেমনিভাবে ক্ষুদ্রশিল্পে মাসে ১৬ হাজার ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে হবে ১৭ হাজার ৩৬০ টাকা। আর মাঝারি শিল্পে গড়ে বিদ্যুতের দাম তিন লাখ ২৬ হাজার টাকা থেকে বেড়ে তিন লাখ ৪৪ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে।
বিদ্যুতের গণশুনানির সময় সব শ্রেণীর গ্রাহকের বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবে বিরোধিতা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিলÑ তেলভিত্তিক উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সংস্কার করলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। এমনিতেই নানা কারণে ব্যবসা-ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো মিলকারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে না। বিদ্যুতের অপচয়, চুরি বন্ধ করা হলে বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হবে না, বরং বিদ্যুতের মূল্য কমানো যাবে। এরপরেও গ্রাহকের কথা বিবেচনা না করে বিদ্যুতের মূল্য কেন বাড়ানো হলোÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, অনেক হিসাবনিকেশ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
কয়েকটি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিট ৫০ টাকা থেকে ৮৩ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখেই গত ১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দায়মুক্তি দিয়ে তিন বছরের জন্য উচ্চ মূল্যের তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বন্ধ না করে বছরের পর বছর চালু রেখে এর দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব ব্যয়বহুল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ না করে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কতটুকু যৌক্তিক এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিইআরসি চেয়ারম্যান কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। তিনি বলেন, সাধারণত, আপদকালীন সময়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতার তিন ভাগের দুই ভাগ থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হয়। আর এক ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়। এ কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয়। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রীষ্মেও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াট। সে হিসাবে উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখার যৌক্তিকতার কি এমন পশ্নেরও তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেনি।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে। এটা অব্যাহত থাকলে সামনে তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে। এমনি পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে বিইআরসি বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর ঘোষণারও কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি বিইআরসি চেয়ারম্যান। শুধু তিনি বলেন, আইনিবাধ্যবাধকতার কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কমিশনের আদেশে বলা হয়েছে, আবাসিকের লাইফ লাইন গ্রাহকদের (শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৯ পয়সা, দ্বিতীয়ধাপে ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা ৭২ পয়সা , তৃতীয়ধাপে ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৫ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা, চতুর্থ ধাপে ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩৪ পয়সা, পঞ্চমধাপে ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ষষ্ঠধাপে ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের জন্য বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করেছে কমিশন। এই স্টেশনে চার্জিংয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ৮৮ পয়সা, সুপার অফপিক সময়ের জন্য ৬ টাকা ১১ পয়সা, পিক সময়ের জন্য ৯ টাকা ৫৫ পয়সা এবং ফ্ল্যাট রেটে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করেছে কমিশন। কৃষিকাজে বা সেচে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৬ পয়সা করা হয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এই দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকবে।’
৮ দফা দাম বৃদ্ধি : বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ শুনানির পর বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। ২০১০ সালের ১ মার্চ গ্রাহক পর্যায় ৬ দশমিক ৭ ভাগ বেড়েছিল। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায় ৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১১ ভাগ বেড়েছিল। ২০১১ সালের ১ আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে বাড়েনি। তবে পাইকারিতে ৬ দশমিক ৬৬ ভাগ বাড়ানো হয়। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১৬ দশমিক ৭৯ ভাগ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১৭ ভাগ, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে ২ দশমিক ৯৩ ভাগ বাড়ানো হয়। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। এরপর সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ ভাগ বাড়ানো হয়। এর পর গতকাল আরেক দফা দাম বাড়ানো হয়।
প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার বৃদ্ধির জন্য গত ১৫ অক্টোবর, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুতের সঞ্চালন মূল্যহার বৃদ্ধির জন্য ২০ অক্টোবর বিইআরসির কাছে আবেদন দাখিল করে। পরে বিইআরসির কাছে বিদ্যুতের সরবরাহ কোম্পানিগুলো পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করে ২০ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে। সংস্থাগুলোর আবেদনের ডরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর বিআইসি গত ২৮ নভেম্বর থেতে তিন ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিজ গণশুনানির আয়োজন করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement