২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গল কামনায় শেষ হলো বিশ্ব ইজতেমা

দু’পক্ষের বিরোধ মেটানোর প্রক্রিয়া চলছে : গাসিক মেয়র

-

টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি লাভের আশায় মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে দুই হাত তুলে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আমিন, আল্লাহুমা আমিন, ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হয়েছে তাবলিগ জামাতের এবারের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। মুনাজাতে লাখ লাখ মুসল্লি নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য কেঁদে বুক ভাসান। মুনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও কামনা করা হয়। মুনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। ইজতেমার এ পর্বে মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীরা অংশ নেন। আখেরি মুনাজাত শুরুর আগে মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের মতো সা’দ অনুসারীদের আগামী ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের নিজামুদ্দিন মার্কাসের হজরত মাওলানা জমশেদ রোববারের এ মুনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি বেলা ১১টা ৪৯ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ০৬ মিনিট পর্যন্ত ১৭ মিনিট স্থায়ী মুনাজাত পবিত্র কুরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াত এবং উর্দু ভাষায় পরিচালনা করেন। তাৎপর্যপূর্ণ এই আখেরি মুনাজাতে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। মোবাইল ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ একসাথে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মুনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চার পাশের এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিসসহ সব কিছু ছিল বন্ধ।
রোববার আখেরি মুনাজাতে শরিক হতে সূর্যোদয়ের আগ থেকে শুরু হয় ইজতেমামুখী ধনী-দরিদ্র, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে লাখো মানুষের ঢল। যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা ধাবিত হন ইজতেমা ময়দানে। ফলে টঙ্গী যেন সব পথের মোহনায় পরিণত হয়। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। গতকাল রোববার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মুনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এ ছাড়াও পার্শ¦বর্তী বাসা-বাড়ি, কলকারখানা-অফিস, দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মানুষ। সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন শুরু হবে সেই কাক্সিক্ষত আখেরি মুনাজাত। আখেরি মুনাজাতের জন্য রোববার আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মুনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মুনাজাতে অংশ নিতে রোববার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছান।
যারা বয়ান করলেন : মুনাজাতের আগে চলে হেদায়তি বয়ান। রোববার সকাল ৯টার পর থেকে আখেরি মুনাজাতের আগ পর্যন্ত তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে হেদায়েতি (দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি) বয়ান করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের নিজামুদ্দিন মার্কাসের হজরত মাওলানা জমশেদ। এ সময় তার বয়ানের বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা আশরাফ আলী। হেদায়েতি বয়ান শেষে মাওলানা জমশেদ আখেরি মুনাজাত পরিচালনা করেন। এর আগে বাদ ফজর থেকে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইকবাল হাফিজ। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম।
বয়ানে যা বলা হয়েছে : বয়ানে মাওলানা জমশেদ বলেন, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় তাবলিগে দাওয়াতি কাজে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধুলাবালু লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠাণ্ডা করে দেয়।
যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের বিধান আনুসারে চলবে এবং হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করবে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব অর্জন করবে। নামাজের আগে আমাদের দিলে একিন বা ঈমান পয়দা করতে হবে। তা না হলে নামাজের ফজিলত পাওয়া যাবে না।
পরবর্তী বিশ^ ইজতেমার তারিখ ঘোষণা : তাবলিগ জামাতের মাওলানা জোবায়ের অনুসারী আলেম ওলেমা কওমিপন্থী এবং মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তাবলিগ অনুসারীদের মতবিরোধের কারণে গত বছরের মতো এবারের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমাও দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম পর্ব সম্পন্ন হওয়ার পর চার দিন বিরতি দিয়ে ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এ বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। এতে মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীরা অংশ নেন। দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মুনাজাতের আগে ইজতেমার বয়ান মঞ্চ থেকে আগামী ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার পৃথক সময়ে দুই পর্বের তারিখ ঘোষণা করা হয়। সা’দ অনুসারীদের ইজতেমা আয়োজক কমিটির শূরা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ তারিখ ঘোষণা করা হয় বলে জানান ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়কারী মো: সায়েম। ঘোষণা অনুযায়ী চলতি বছরের ২৫, ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর প্রথম পর্ব এবং ২০২১ সালের ১, ২ ও ৩ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও আগামী ১৩ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানে সা’দ অনুসারীদের পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
অন্য দিকে গত ১০-১২ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এবারের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এ পর্বে মাওলানা জোবায়ের অনুসারীরা অংশ নেন। ১২ জানুয়ারি ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মুনাজাত শুরুর আগে মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের ৫৬তম বিশ^ ইজতেমার পৃথক সময়ে দুই পর্বের তারিখ ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ২০২১ সালের ৮, ৯ ও ১০ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব একই বছরের ১৫, ১৬ ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ইজতেমা ময়দানে পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে দেশ-বিদেশের মুরব্বিদের পরামর্শ বৈঠকে (মাশওয়ারায়) আগামী বিশ্ব ইজতেমা ও জোড় ইজতেমার তারিখ চূড়ান্ত করা হয়।
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বিরা জানান, সাধারণত বিশ্ব ইজতেমার কমপক্ষে ৪০ দিন আগে জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। জোড় ইজতেমায় তাবলিগের সব সাথী অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কমপক্ষে তিন চিল্লার সাথীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ জোড় ইজতেমা। তিন চিল্লার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু অংশ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজনে টঙ্গীর ইজতেমার ময়দানে কাজে যোগদান করেন। স¤পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানের যাবতীয় কাজ স¤পন্ন করেন তারা। আর বাকি সাথীরা বিশ্ব ইজতেমার দাওয়াত নিয়ে ময়দানে বেরিয়ে পড়েন।
মাওলানা সা’দ কান্ধলভীকে নিয়েই আগামী ইজতেমা করতে চান তার অনুসারীরা : আগামী বছর থেকেই মাওলানা সা’দ কান্ধলভীকে নিয়ে টঙ্গীর ময়দানে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা করতে চান তার অনুসারীরা। এর আগেই উভয়পক্ষের বিরোধ মিটে যাবে বলেও আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত শনিবার রাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মো: জাহাঙ্গীর আলমের সাথে ইজতেমা ময়দানে আলাপকালে চট্টগ্রামের লালখান জমিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমির মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর কিছু বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তিনি সেসব বক্তব্যের ব্যাপারে একটি সমাধানে পৌঁছানোর পর আগামীতে টঙ্গী ইজতেমায় তার যোগদানের পথ সুগম হবে বলে মনে করছেন তাবলিগ সাথীরা। এ দিকে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও গাজীপুর সিটি মেয়র মো: জাহাঙ্গীর আলম প্রথম পর্বের মতো ইজতেমার এ পর্বেও তাবলিগ জামাতের মুরব্বিদের সাথে ময়দানে নিবিড়ভাবে সময় দিয়েছেন। রাত-দিন তারা ময়দানে মুরব্বিদের সাথেই অবস্থান করেছেন। প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম শনিবারও ইজতেমা ময়দানে মুরব্বিদের সাথে রাত কাটান।
ইজতেমার মুরুব্বিদের বরাত দিয়ে তাবলিগ জামাতের নিজামউদ্দিন মারকাজের মিডিয়া সমন্বয়কারী মো: সায়েম জানান, আমাদের মতানৈক্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইজতেমা। ধীরে ধীরে ইজতেমায় বিদেশী মুসল্লি আসা কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এটি আর বিশ^ ইজতেমা থাকবে না। তখন এটি বাংলাদেশের ইজতেমায় পরিণত হবে। আগে যেখানে শতাধিক দেশ থেকে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার বিদেশী মুসল্লি আসতেন, এখন দুই পর্বে মাত্র আসছেন পাঁচ হাজারের মতো মুসল্লি। তাই ঐক্যবদ্ধ ইজতেমা খুব জরুরি।
এক পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে মেয়র জাহাঙ্গীরের উদ্যোগ : এ দিকে ইজতেমার আখেরি মুনাজাত শেষে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম জানান, দেশ-বিদেশ থেকে আসা লাখ লাখ মুসল্লির খেদমতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে সফলভাবে ইজতেমা সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ জন্য ইজতেমায় যোগ দেয়া সব মুসল্লি ও গাজীপুর সিটিবাসীকে ধন্যবাদ জানান।
আরো তিন মুসল্লির মৃত্যু : এবারের বিশ^ ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতে আসা আরো তিন মুসল্লি মারা গেছেন। এদের মধ্যে শনিবার রাতে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার চাঁদপাড়া দুর্গাদাহ এলাকার মৃত মুজিবুর রহমানের ছেলে মো: শাহ আলম (৬৫) ও চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার খাদিমপুর এলাকার মৃত মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে ফজলুল হক (৬৮) এবং শনিবার সকালে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানার আজিমনগর এলাকার মৃত মফিজুল ইসলামের ছেলে মো: মনির হোসেন (৪০) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ নিয়ে এ পর্বে মোট ১০ মুসল্লি মারা গেছেন।
মুনাজাত শেষে জনজট ও যানজট : আখেরি মুনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লিরা তাড়াহুড়া করতে শুরু করে। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট।

 


আরো সংবাদ



premium cement