১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নিভে গেল অভাবের সংসারের প্রদীপটা আগুনে পুড়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪

-

চৌদ্দ বছরের কিশোর আসাদ। চার ভাই বোনোর মধ্যে সে তৃতীয়। বাবা শ^াসকষ্টের রোগী। বয়সের কারণে কাজকর্ম করতে পারেন না। অসুস্থ মাও। আগে মা ইট ভাঙার কাজ করলেও এখন আর করতে পারেন না। ফলে অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে বড় হচ্ছিল ছেলেটি। বড় ভাই সোহেল কাজ করত একটি বেকারিতে, তিনিও এখন বেকার। তাই সংসারের দৈন্যতা দূর করতে কেরানীগঞ্জের প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করত আসাদ। লেখাপড়ার স্বপ্ন থাকলেও হয়ে উঠেনি। তবুও স্বপ্ন বুনতো পরিবারের হাল ধরার, বড় বোনের বিয়ে দেয়ার। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আসাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। কারখানার ভয়াবহ আগুন ছেলেটিকে বাঁচতে দিলো না। অভাবের সংসারে বাবা-মায়ের একমাত্র আশার আলো, আশার প্রদীপটি নিভে গেলো কিশোর বয়সেই। আগুনে পোড়া শরীর নিয়ে মেডিক্যালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতড়ালেও বড় বোনের বিয়ের খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল তার। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) মারা যায় আসাদ। এ নিয়ে কারখানার আগুনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৪। আসাদের মৃত্যুর খবরে আইসিইউর সামনে স্বজনদের আহাজারিতে স্তব্ধ সবাই। স্বজন হারাদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা জানা নেই কারও।
ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক সামন্তলাল সেন জানান, আসাদের শরীরের শতকরা ৫০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল। তার শ্বাসনালীও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই শত চেষ্টার সত্ত্বেও বাঁচানো যায়নি আসাদকে।
আসাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের কাউয়ার চরে। কেরানীগঞ্জে ভাড়া বাসায় সপরিবারে থাকত সে। বড় বোন শিরিন, মেজোভাই সোহেল ও ছোটবোন আরিফা। বাবা অসুস্থ ও ভাই সোহেল বেকার হওয়ায় আসাদের টাকায় চলত সংসার। সে ওই কারখানায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করত ১৩ হাজার টাকা বেতনে।
আসাদের খালা মুন্নি বলেন, দুই বছর ধরে আসাদ ইলেকট্রিকের কাজ করত। কাজ ভালো করত বলে সবাই তাকে পছন্দও করত। এর আগেও একবার ওই ফ্যাক্টরিতে যখন আগুন লাগে তখন আসাদকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। পরে সেখানকার সুপারভাইজার তাকে জোর করে নিয়ে চাকরিতে যোগ দেয়ায় ১৩ হাজার টাকা বেতন ধরেছিল। বয়স অল্প হলেও কাজে দক্ষ ছিল সে। প্রায়ই বলত, বড় আপার বিয়ের খরচ পুরোটাই সে দিবে। সংসারের খরচও সেই চালাত। সে জন্যই হাসপাতালের বেডে শুয়ে বোনের বিয়ের কথা বলছিল।
মুন্নি বেগম আরও বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে সাথে সাথেই আসাদের মোবাইলে ফোন করা হয়। ফোনে রিঙও হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম, ফোনে যেহেতু রিঙ হয়েছে সেহেতু সে ভালো আছে। তার একটু পরে যখন ফ্যাক্টরি থেকে একের পর এক পোড়া মানুষ বের করছে তখন আমরা ওকে খুঁজে পাই না। পরে আমরা কারখানায় যাই। সেখানে গিয়েও তাকে পাওয়া যায় না। তখনও আমাদের বলে নাই তাদের ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসা হয়েছে। রাত ৮টার দিকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আসাদ বার্ন ইউনিটে ভর্তি।
আসাদের ভাই সোহেল বলেন, ওকে কাজে দেয়ার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে সে নিজে থেকেই কাজ করতে চেয়েছিল। ইলেকট্রিকের কাজ সে ভালো করত।
গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে কেরানীগঞ্জের চুনকুঠিয়ায় প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানাটিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় সোয়া এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।


আরো সংবাদ



premium cement