২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণহত্যার দায় অস্বীকার সু চির

নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি -

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিজেদের পক্ষে গতকাল বুধবার বক্তব্য দিয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সন সু চি। তিনি বলেছেন, তার দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই। তার দাবি, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদ এখানে প্রযোজ্য নয়।
আদালতে অভিযোগকারী গাম্বিয়ার বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলে মন্তব্য করেন তিনি। নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানির দ্বিতীয় দিনে গতকাল বুধবার অং সান সু চি এসব কথা বলেন।
বক্তব্যের শুরুতে সু চি আন্তর্জাতিক আইন ও সনদগুলোর বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে আদালত সহায়তা করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। গণহত্যা সনদের বিধান রুয়ান্ডা ও সাবেক যুগোসøাভিয়ায় প্রয়োগ করা হয়নি বলে দাবি করে তিনি অভিযোগ করেন, গাম্বিয়া বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে।
আরাকানে মুসলমানদের ইতিহাস বর্ণনা করে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে তিনি সঙ্ঘাতের ফল হিসেবে অভিহিত করেন। কয়েক শ’ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে বক্তব্য দিলেও তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ তদন্ত ও বিচারব্যবস্থা এ নিয়ে কাজ করছে।
সু চি বলেন, ক্লিয়ারেন্স অপারেশনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুধু সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবেলার প্রশ্নে ব্যবহৃত হয়েছে। তার দাবি, রাখাইনে কোনো ধরনের বৈষম্য করা হবে না। মুসলমান শিশু ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি চালু করা হচ্ছে। তিনটি আইডিপি (ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল) শিবির বন্ধ করা হয়েছে। দেশান্তরিত লোকজনকে স্বেচ্ছামূলক ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, এ রকম অবস্থায় কিভাবে বলা হয় যে, গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে কার্যক্রম চলছে? তিনি জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তার দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এই আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে চালানো এক সেনা অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয় এবং সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
অং সান সু চি বলেন, মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ‘অসম্পূর্ণ ও বেঠিক’। তার কথায়, ওই সেনা অভিযানের পেছনে গণহত্যা চালানোর অভিপ্রায়ের কোনো প্রমাণ নেই। সু চি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি উপলব্ধি করা সহজ নয়, এবং ২০১৭ সালের আগস্টের ঘটনাবলি শুরু হয়েছিল যখন স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পুলিশ ফাঁড়ির ওপর আক্রমণ চালায়। তবে তিনি স্বীকার করেন, মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা বাহিনী হয়তো মাত্রাতিরিক্ত রকমের শক্তি প্রয়োগ করে থাকতে পারে। যদি মিয়ানমারের সৈন্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের বিচার করা হবে।
মিয়ানমারের রাখাইনের ঘটনাবলি সম্পর্কে গাম্বিয়া অসম্পূর্ণ ও বাস্তবতাবর্জিত অভিযোগ উত্থাপন করেছে বলে মন্তব্য করে দেশটির রাষ্ট্রীয় পরামর্শক ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চি বলেছেন, অভিযোগগুলো আদালতকে মাঠপর্যায়ে যথাযথভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি জটিল। সেখানে আরাকান আর্মির সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্ঘাত চলছে। রাখাইনে সঙ্ঘাত উসকে দেয় বা শান্তিশৃঙ্খলা বিঘিœত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতকে (আইসিজে) বিরত থাকার আহ্বান জানান সু চি।
গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়া গণহত্যা-সংক্রান্ত সনদ ভঙ্গের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে মামলা করেছে। গাম্বিয়ার অভিযোগ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, যার প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার শুনানির শেষ দিনে গাম্বিয়া ও মিয়ানমার পাল্টাপাল্টি যুক্তি-তর্ক উত্থাপনের সুযোগ পাবে। এরপর আইসিজে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে করা মামলায় গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, জীবিকা ধ্বংস ও নিপীড়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক এ আদালতের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ চেয়েছে।
গণহত্যা সংক্রান্ত সনদ ভঙ্গের জন্য মিয়ানমারকে আইসিজের সামনে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ এনে সু চি বলেন, রুয়ান্ডায় তুতসিদের ওপর চালানো বর্বরতম গণহত্যা, কসোভো থেকে ১০ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতি বা ক্রোয়েশিয়া থেকে সার্বদের ব্যাপকভিত্তিক বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে এই আদালতে কোনো অভিযোগ আসেনি।
তিনি বলেন, রাখাইনের এই জটিল পরিস্থিতির জন্য গত শতাব্দী থেকে চলে আসা ঘটনাপ্রবাহ দায়ী। বিগত কয়েক বছরে তা জটিলতর রূপ ধারণ করেছে। এখন রাখাইনে সশস্ত্র বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের নিয়মিত বাহিনীর লড়াই চলছে। আরাকান আর্মি রাখাইনের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা চায়। এ সঙ্ঘাত রাখাইনে হাজারো মানুষের বাস্তুচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাইনে সান্ধ্য আইন ও নিরাপত্তা চৌকির কড়াকড়ি রয়েছে। এতে ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে রাখাইনের সব অধিবাসীই কষ্টের মধ্যে রয়েছে। ক্রমাগত সঙ্ঘাতের কারণে রাখাইন এখন মিয়ানমারের দ্বিতীয় দরিদ্রতম রাজ্য।
সু চি বলেন, বিশেষ করে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে অঞ্চলটিতে সশস্ত্র সঙ্ঘাত বহু মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এসব মানুষ রাখাইন থেকে পালিয়ে গিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) ৪০০ যোদ্ধা বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উত্তর রাখাইনের মংডু ও রুথিডাং এলাকায় পুলিশ ক্যাম্পগুলোতে সমন্বিত আক্রমণ চালায়। এ ঘটনায় ৯ পুলিশ কর্মকর্তা ও শতাধিক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। এ সময় পুলিশের ৬৮টি অস্ত্র ও ১০ হাজার গুলি লুট করা হয়। আরসা ও মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘাতের জের ধরে এ ঘটনা ঘটে। আরসা ঘটনার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এ ধরনের ঘটনা ২০১৭ সালের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে গিয়ে গাম্বিয়া এসব ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে উল্লেখ করেছে।
তিনি বলেন, পুলিশ ক্যাম্পে হামলার পর আরসা উত্তর রাখাইনের কয়েকটি অঞ্চলে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। সমর্থন ও আনুগত্য লাভের জন্য আরসা স্থানীয় অধিবাসীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এ সময় সন্দেহভাজন ইনফরমারদের (নিরাপত্তা বাহিনীকে গোপনে খবর দেয়া ব্যক্তি) হত্যা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে, আরসা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গিদের কাছ থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভোরে সহ¯্রাধিক আরসা যোদ্ধা উত্তর রাখাইনে ৩০টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায়। মংডু শহর দখল করার জন্য আরসা এই হামলা চালায় বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা হামলা চালালে সঙ্ঘাত বেধে যায়। এরপর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসীদের দমনে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে। এ সময় আরসার অনেক সদস্য নিহত হয়। অন্তত ১২টি স্থানে কয়েক শ’ মানুষ হতাহত হয়েছে। কিছু এলাকায় আন্তঃধর্মীয় সঙ্ঘাতও শুরু হয়ে যায়। সঙ্ঘাত থেকে বাঁচতে এবং আরসার ভয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসহ অনেকেই রাখাইন থেকে পালিয়ে যায়। একটি ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছিল। এতে বেসামরিক কিছু মানুষ হতাহত হয়।
সু চি বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের কোর্ট মার্শাল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। রাখাইন বা মিয়ানমারের অন্য কোনো স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো বেসামরিক ব্যক্তি এতে জড়িত থাকলে শাস্তি পেতে হবে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ ন্যায়বিচার আন্তর্জাতিক বিচারের চেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সম্ভব সব কিছু করা হবে। সামরিক বাহিনীর সদস্য অপরাধী হলে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুতদের ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাখাইনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষদের (আইডিপি) ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, এ রকম অবস্থায় কিভাবে বলা হয় যে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে কার্যক্রম চলছে?
শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে আইনগত ব্যাখ্যা দিয়ে অধ্যাপক শেবাস বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে গাম্বিয়া বারবার জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনেছে। প্রতিবেদনে রাখাইনে গণহত্যার অভিপ্রায় পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের জন্য অভিপ্রায় যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অকাট্য তথ্য-প্রমাণ।


আরো সংবাদ



premium cement