১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেয়েদের ক্রিকেটে স্বর্ণ জয়

আরচারির ৬ স্বর্ণের আলোতে উদ্ভাসিত বাংলাদেশ
এসএ গেমসে মেয়েদের ক্রিকেটে স্বর্ণ জয়ের পর উল্লসিত ক্রিকেট দলের গর্বিত সদস্যরা : বিসিবি -


বাংলাদেশের জন্য দিনটি ছিল রেকর্ডময়। একদিনে ৭ স্বর্ণপদক জয়। নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশের লড়াকু ক্রিকেটাররা উত্তেজনার পারদ উপরের দিকে উঠিয়ে শেষ হাসি হেসেছে। শ্রীলঙ্কাকে লেট স্কোরিং ম্যাচে পরাজিত করে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। এ প্রাপ্তির কোনো তুলনা চলে না। নারী ক্রিকেটে পাশাপাশি সোনালি কাব্যের অধ্যায় রচনা করেন আরচাররা। তারা দেশকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে এসএ গেমসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। রোমান সানী, ইতি বেগম নিজেদের নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়।
এসএ গেমসের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে দামী স্বর্ণ ফুটবলে! ডজন দুইয়েক স্বর্ণ পেলেও ফুটবলে স্বর্ণ না জিতলে সবই যেন বৃথা! ক্রিকেট যুক্ত হওয়ার পর ফুটবলের পরই স্বর্ণের দামে এগিয়ে ক্রিকেটও। বাংলাদেশের মেয়েরা ক্রিকেটে তেমনই এক স্বর্ণ জিতেছে এসএ গেমসে। উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে কম পুঁজি নিয়েও শেষ পর্যন্ত জিততে পেরেছে তারা বোলারদের নৈপুণ্যে। শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে হারিয়েছে তারা ২ রানে। ম্যাচ জিতে স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের মেয়েরা। কিন্তু এর মাঝেও কোথাও যেন একটু খোঁচাও লেগেছে! শ্রীলঙ্কা যেখানে খেলিয়েছে অনূর্ধ্ব-২৩, সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় দল। এ পার্থক্যে বাংলাদেশ দলের প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দেয়ার কথা। সেখানে ধুঁকতে হয়েছে। কষ্টটা সেখানেই। সম্মান শেষ পর্যন্ত রাখতে পেরেছেন তারা। নতুবা ইজ্জত হারানোর অবস্থায় পরে গিয়েছিলেন তারা। পোখরায় অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে টসে জিতে শ্রীলঙ্কানরা ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশের মেয়েদের। ১৬ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ভালোই এগোচ্ছিলেন তারা। কিন্তু দলীয় ৩৬ রানে ভয়াবহ এক বিপর্যয়ে পড়ে তারা। লঙ্কান বোলার থিমাসিনির মারাত্মক বোলিংয়ে বিধ্বস্ত যেন ব্যাটিং। থিমাসিনির করা ইনিংসের সপ্তম ওভারে চার উইকেট হারায় বাংলাদেশ। অল্পের জন্য হ্যাটট্রিক হয়নি। প্রথম বলে আয়শা আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় বলে আউট সানজিদা। তৃতীয় বলটিতে কোনো আউট না হয়ে বেঁচে যায়। এরপর চতুর্থ বলে আউট ফারজানা এবং শেষ বলে আউট হয়ে যান রিতু মনি। বাংলাদেশের মেয়েরা যেন বিধ্বস্ত!
পরে নিগার সুলতানা ও ফাহিমা মিলে দলীয় স্কোর নিয়ে যান ৯১তে। আট উইকেট হারিয়ে ওই রান করেন তারা। থিমাসিনি ৮ রানে নেন চার উইকেট।
বাংলাদেশের এমন স্কোরে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। এ স্কোর নিয়ে লড়াই সম্ভব না। ফলে সব চাপ পড়ে বোলারদের ওপর। বোলারদের হাতেই চলে যায় স্বর্ণের সব আশা ভরসা। কিন্তু বিমুখ করেনি তারাও। অধিনায়ক সালমাই শুরু করেন। ৪ রানে অনালীকে ফেরত পাঠিয়ে দলকে উজ্জীবিত করেন। এরপর নাহিদা, জাহানারা, খাদিজারা মিলে অনেকটাই ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলেন লঙ্কান ইনিংসে। ৭৬ রানের মধ্যে হারিয়ে ফেলে তারা ৬ উইকেট। তবে জয়ের সুযোগ তারপরও ছিল। কিন্তু শেষ ওভারে ৭ রান প্রয়োজন পরে শ্রীলঙ্কার, হাতে তিন উইকেট। জাহানারা শেষ ওভার করতে এসে উত্তেজনাকর ওভারের প্রথম তিন বলে দেন দুই রান। ফলে শেষ তিন বলে প্রয়োজন ছিল ৫ রান। চার নিলে টাই। কিন্তু জাহানারা ২ রান দিলেও তুলে নেন ২ উইকেট। এতে জয় নিয়ে স্বর্ণ নিশ্চিত করে জয়ের আনন্দে মেতে ওঠেন টিম বাংলাদেশ। নাহিদা নেন দুই উইকেট।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ মহিলা দল : ৯১/৮ (২০ ওভারে), মুর্শিদা খাতুন ১৪, আয়শা রহমান ২, সানজিদা ১৫, নিগার ২৯ অপ:, ফারজানা ০, রিতু মনি ০, সালমা ৩, ফাহিমা ১৫, জাহানারা ২, নাহিদা ০ অপ:; সান্দিপানি ১/১৮, সেওয়ান্দি ১/২০, দিলহারি ১/২০, থিমাসিনি ৪/৮, রানাতুঙ্গা ১/৬, নিশানসালা ০/১৬)।
শ্রীলঙ্কা মহিলা অনূর্ধ্ব-২৩ দল : ৮৯/৯ (২০ ওভারে) থিমাসিনি ৭, আনালি ১, মাদাভি ৩২, সান্দিপানি ০, দিলহারি ৪, আপ্সারা ২৫, সান্দামিনি ১০, ভিজেনায়েকে ১, নিশানসালা ১ অপ:, রানাতুঙ্গা ১; জাহানারা ১/১৭, সালমা ১/১২, নাহিদা ২/৯, খাদিজা ১/২১, ফাহিমা ০/২৫।
ফল : বাংলাদেশ ২ রানে জয়ী।
স্বর্ণপদকের ডাবল হ্যাটট্রিকে আরচারি : সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্নপূর্ণা পর্বতের উচ্চতা প্রায় চার হাজার ফুট উপরে। সকালের সূর্যের আলোতে চিকচিক করছিল পর্বতের চূড়া। সারা পৃথিবীতে এমন দৃশ্য বিরল। গতকাল সেটিকেও যেন হার মানাল বাংলাদেশ আরচারির ছয় সৈনিক এবং মহিলা ক্রিকেট দলের সদস্যরা। শুধু সাত স্বর্ণপ্রাপ্তিই নয়; আজ আরচারির আরো চারটি ইভেন্টে জিততে পারে স্বর্ণ। সুযোগ থাকছে ব্যক্তিগতভাবে রুমান সানা, ইতি খাতুনের হ্যাটট্রিক স্বর্ণপদকের।
কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের ২০টি ডিসিপ্লিনে খেলে এসেছে পাঁচটি স্বর্ণ। এরমধ্যে কারাতে থেকে তিনটি, তায়কোয়ানডো ও ফেন্সিং থেকে একটি করে। এ দিকে পোখারায় পাঁচটি ডিসিপ্লিনের মধ্যে এখন পর্যন্ত পদক এসেছে ৯টি। ভারোত্তোলনে দু’টির পর গতকাল আরচারি থেকে ছয়টি ও মেয়েদের ক্রিকেট থেকে একটি। ২০১৬ সালে পদক ছিল মাত্র চারটি। ২০১০ সালে ঢাকার আসরে পদক ছিল ১৮টি। আট দিন শেষে গেমসে বাংলাদেশের মোট স্বর্ণপদক এখন ১৪। গেমসের বাকি রয়েছে আর দু’দিন। হাতছানি দিচ্ছে আরেকটি রেকর্ডের। এবারের গেমসে আর মাত্র চারটি স্বর্ণ দূরে সেই রেকর্ড স্পর্শ করতে।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা ১৪ স্বর্ণ জয়ের পর খানিকটা নির্ভার, ‘আমরা এ রকম কিছুই প্রত্যাশা করেছিলাম। আরচ্যারি, বক্সিং, কুস্তি, পুরুষ ক্রিকেটের স্বর্ণের লড়াইয়ে রয়েছি আমরা। আশা করি আরো বেশ কয়েকটি স্বর্ণ আসবে।’
অন্নপূর্ণা পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত পোখারা রঙ্গশালা স্পোর্টস কমপ্লেক্স। যেখানে এসএ গেমসের ক্রিকেট, আরচারির ফাইনাল। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পরিবেশ উধাও হয়ে গেল বাংলাদেশ অ্যাথলেটদের মনের জোর এবং আত্মবিশ্বাসের কাছে। পদক জয়ের পথে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হতে লাগলো প্রকৃতি ও পরিবেশ। এমন আলোর ছটায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট। উপমহাদেশের ইতিহাসে একদিনে এক ইভেন্ট থেকে ছয়টি স্বর্ণপদক জয় করে বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করল দেশের অ্যাথলেটরা। স্বর্ণের ডাবল হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হলো।
আরচারি গ্রাউন্ডের পাশেই ক্রিকেট স্টেডিয়াম। শুধু আরচারিই নয়; বাংলাদেশের মেয়েরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়ে উপহার দিয়েছে আরো একটি স্বর্ণ। দুই মাঠেই বাংলাদেশের সাপোর্টারদের আনন্দের ধ্বনি শুনা যাচ্ছিল। কেউ কি কল্পনা করেছিল এমন দিন আসবে বাংলাদেশের। হেসেছে পোখারা, হেসেছে বাংলাদেশ। যেখানে পোডিয়ামে একবার জাতীয় সঙ্গীত বাজার জন্য অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। সেখানে একদিনেই এক মঞ্চে সাতবার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজা চাট্টিখানি কথা নয়।
একদিনে সাত স্বর্ণপ্রাপ্তিতে খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশি আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন ফেডারেশন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের উৎসবের প্রকাশটা ছিল কিছুটা ভিন্ন। খেলোয়াড়দের মতো হই হই রই রই ব্যাপারটা ছিল না। বিওএ সহ সভাপতি বশির আর মামুনকে যেমন মাঠের পাশে থেকে ‘কামান গার্লস’, ‘গুড ফিল্ডিং’, ‘ক্যাচ ইট’ বলতে শুনা গেছে তেমনি আরচারির সেক্রেটারি রাজীব উদ্দিন আহমেদ চপলকে দেখা গেছে স্বর্ণজয়ীদের জড়িয়ে ধরে সাবাশি দিতে কিংবা হ্যাটট্রিক স্বর্ণের আগে টেনশনে খেলাই দেখেননি। বসেছিলেন অফিসের পেছনের বারান্দায়। শেফ দ্য মিশন আসাদুজ্জামান কোহিনুর স্বভাবসুলভ হাসিতেই ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলেন একটি স্বর্ণ যদি হ্যান্ডবল থেকে পাওয়া যেতো। তবে বাংলাদেশ পুরুষ হ্যান্ডবল দল পাকিস্তানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে। বিওএ উপমহাসচিব আশিকুর রহমান মিকুর আনন্দের মধ্যে নিজের ডিসিপ্লিন ভলিবলের কথাও হয়তো মনে পড়েছে। বিওএ সদস্য এবং বাস্কেটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ কে সরকারের হয়তো কোনো জায়গায় খটকা ছিল।
বাংলাদেশ আরচারি দল গতকাল দলগত ছয়টি ইভেন্টের মধ্যে ছয়টিতে গোল্ড মেডেল জয় করেছে। আজ একক ইভেন্টে চারটি গোল্ড মেডেল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। আরচারি ডিসিপ্লিনের তৃতীয় দিনে রিকার্ভ পুরুষ দলগত ইভেন্টে বাংলাদেশের মো: রুমান সানা, মোহাম্মদ তামিমুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হাকিম আহমেদ রুবেল ৫-৩ সেট পয়েন্টে শ্রীলঙ্কাকে, মহিলা ইভেন্টে ইতি খাতুন, মেহনাজ আক্তার মনিরা ও বিউটি রায় ৬-০ সেট পয়েন্টে শ্রীলঙ্কাকে, রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে রুমান সানা ও মোসাম্মৎ ইতি খাতুন ৬-২ সেট পয়েন্টে ভুটানকে, কম্পাউন্ড পুরুষ দলগত ইভেন্টের ফাইনালে সোহেল রানা, অসীম কুমার দাস ও মোহাম্মদ আশিকুজ্জামান ২২৫-২১৪ স্কোরে ভুটানকে, মহিলা দলগত ইভেন্টে ফাইনালে সুস্মিতা বনিক, সুমা বিশ্বাস ও শ্যামলী রায় ২২৬-২১৫ স্কোরে শ্রীলঙ্কাকে এবং সর্বশেষ কম্পাউন্ড মিশ্র দলগত ইভেন্টে ফাইনালে সোহেল রানা এবং সুস্মিতা বনিক জুটি ১৪৮-১৪০ স্কোরে নেপালের প্রতিযোগীকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করেন।
কাজী রাজিব উদ্দিন আহমেদ চপল জানান, ‘অধ্যাবসায়, কম কথা বলা, নিয়মিত প্রশিক্ষণে ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করার ফসল এই পদক। আমি কখনো আগ বাড়িয়ে বলি না এটা করব, ওটা জিতব। ফল হলে সবাই দেখবে। বিশ্বাস আছে তীরন্দাজদের প্রতি। তারা দেশকে হতাশ করেননি বরং উৎসাহ দিয়ে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মকে।’


আরো সংবাদ



premium cement