২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দেশে পর্যাপ্ত মজুদ আছে : শিল্প মন্ত্রণালয়

লবণ নিয়েও হুলস্থুল

সারা দেশে আটক শতাধিক
-

জোগান ও সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও সারা দেশে লবণের দাম বাড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে লবণ সংগ্রহ করতে দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভের চেষ্টা করছেন। ব্যবসায়ীরা বেশি দামে লবণ বিক্রির জন্য দোকান থেকে লবণ সরিয়ে ফেলার অভিযোগ করেছেন ক্রেতারা। মুদিদোকানে লবণ না পেয়ে দোকান ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে কয়েকটি জেলায় প্রশাসন বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়েছে। বেশি দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক দোকানমালিককে। লবণের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। দেশে লবণের কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়ে এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি লবণ মজুদ রয়েছে। পেঁয়াজের দাম নিয়ে অস্থিরতা না কাটতেই নিত্যপণ্য লবণ নিয়ে হুলস্থুল বাধানোর চেষ্টাকে নজিরবিহীন মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মুদিদোকানগুলোয় লবণ কিনতে মানুষের প্রচুর ভিড় দেখা যায়। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারীক্রেতা। তারা দুই থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত লবণ কিনছিলেন। দোকানে লবণ বিক্রি শেষ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতাদের চাপে কয়েকটি দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। একটি দোকানে লবণ ফুরিয়ে যাওয়ায় মজুদদারির অভিযোগে দোকান ভাঙচুরের চেষ্টা চালান কয়েকজন ক্রেতা। মুগদা এলাকায় অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে ২০ জন দোকানমালিককে আটক করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়াও রাজধানীর কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পল্লবী, খিলগাঁও, আগারগাঁও, তেজগাঁও ও বেগুনবাড়ি এলাকার বাজার ও মুদিদোকানে লবণ কিনতে ক্রেতাদের বাড়তি ভিড় দেখা যায়। বাসাবোর মায়ের দোয়া স্টোরের মালিক সুমন বলেন, ক্রেতাদের বাড়তি চাহিদা থাকায় এক বস্তা লবণ শেষ হয়ে গেছে।
বিকেলে কাপ্তান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বাজার অনেকটা লবণশূন্য হয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কারো কাছে এক কেজির বেশি লবণ বিক্রি না করার নির্দেশ প্রদান করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাজারে এখন সবচেয়ে ভালো মানের লবণের প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরামূল্য লেখা ৩৫ টাকা। আর সাধারণ লবণের সর্বোচ্চ খুচরামূল্য ২৫ টাকা। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিপণনকারী কোম্পানি এক কেজি লবণ বিক্রি করে ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে। বাজারের বড় দোকানগুলোতে এসব লবণ ৩০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেত। গতকাল সকাল থেকে ক্রেতাদের বাড়তি চাপ দেখায় খুচরা বিক্রেতারা এখন আর ছাড় দিয়ে বিক্রি করছেন না। অন্য দিকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চড়া দামে লবণ বিক্রির খবর আসছে।
রাজধানীর টিকাটুলী থেকে লবণ কিনে ফিরছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মুকুল। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩০ টাকার পেঁয়াজ ২৫০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। এখন যদি লবণেও তেমন হয়। তাই কিনে রাখছি। লবণের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এসিআই সল্ট বলছে, কোনো ঘাটতি নেই। তারা লবণের দাম কোনোভাবেই বাড়ায়নি এবং বাড়াবে না; বরং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি কেউ এসিআইয়ের লবণ বিক্রি করছে কি না, সেটা তারা নজরে রাখবে।
ইসলামপুর লবণ মিলমালিক সমিতি কক্সবাজারের সভাপতি শামসুল আলম আজাদ নয়া দিগন্তকে বলেন, বর্তমানে আমাদের হাতে ৪ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিকটন লবণ রয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে নতুন লবণ উঠলে ৭ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিকটনে দাঁড়াবে। কারণ, চাহিদা থেকে অনেক বেশি লবণ মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছেও লবণ রয়েছে। আমরা লবণের যে দাম, সেই দামে বিক্রি করছি। আমরা লবণের কোনো দাম বাড়াইনি। বাজারে লবণের জোগান ও সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য একটি মহল এমন গুজব ছড়াচ্ছে। গুজব রটনাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
দাম বাড়ালে জেল-জরিমানা : বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, কোনোভাবেই লবণের দাম বাড়ার কারণ নেই। আমাদের দেশীয় লবণচাষিদের সুবিধা দেয়ার জন্য আমরা আমদানিও বন্ধ করে রেখেছি। দাম এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বাড়িয়েছে। তাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রধানকে বলেছি, এ মুহূর্তে বাজার মনিটরিং করে দাম বাড়ানো এবং কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করলে জড়িতদের জেল-জরিমানা করেন। যাকে জেল দেয়া দরকার তাকে জেল দেন, যাকে জরিমানা করা দরকার তাকে জরিমানা করেন। গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, লবণের বিষয়ে আমাদের সরকারের তরফ থেকে একটাই কথাÑ একটা গুজবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবাস্তব সুযোগ নিয়েছে। যদিও লবণের বিষয়টা শিল্প মন্ত্রণালয় দেখে, তারপরও আমি আসার আগে এ খবরটাও নিয়ে এসেছি।
কোনো সঙ্কট নেই : এ দিকে লবণের কোনো সঙ্কট নেই জানিয়ে গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন। বর্তমানে দেশে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটনের বেশি ভোজ্যলবণ মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের চাষিদের কাছে ৪ লাখ ৫ হাজার মেট্রিকটন এবং বিভিন্ন মিলের গুদামে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিকটন লবণ মজুদ রয়েছে। গতকাল শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণসঙ্কটের গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সারা দেশে বিভিন্ন লবণ কোম্পানির ডিলার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে লবণ মজুদ রয়েছে। পাশাপাশি চলতি নভেম্বর মাস থেকে উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া ও মহেশখালী উপজেলায় উৎপাদিত নতুন লবণও বাজারে আসতে শুরু করেছে। দেশে প্রতি মাসে ভোজ্যলবণের চাহিদা কম-বেশি এক লাখ মেট্রিকটন। অন্য দিকে লবণের মজুদ আছে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিকটন। সে হিসাবে লবণের কোনো ঘাটতি বা সঙ্কট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
বিসিকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, লবণচাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সরকারের সার্বিক সহায়তার ফলে লবণ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লবণ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রেকর্ড পরিমাণ ১৮ দশমিক ২৪ লাখ মেট্রিকটন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে লবণ মজুদের পরিমাণ সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটন। এ ছাড়াও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের লবণ মৌসুমে চাষিরা লবণ চাষ শুরু করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বর্তমানে দেশে লবণের কোনো সঙ্কট নেই এবং সঙ্কট হওয়ার কোনো আশঙ্কাও নেই মর্মে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে অবগত করানোর জন্য বিসিকের জেলা কার্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। লবণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশনের জন্য বিসিকের প্রধান কার্যালয়ে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর ০২-৯৫৭৩৫০৫।
এ দিকে লবণ সংক্রান্ত বিষয়ে তদারকির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রধান কার্যালয়ে ইতোমধ্যে একটি কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। এর নম্বর ০২-৯৫৭৩৫০৫ (ল্যান্ড ফোন) ও ০১৭১৫-২২৩৯৪৯ (সেল ফোন)। লবণ সংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের প্রয়োজনে কন্ট্রোলরুমের সাথে যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী : লবণের গুজব ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর নয়াবাজারে অভিযান চালিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন দু’জনকে আটক করে। তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি এলাকা থেকে দুই ব্যবসায়ীকে আটক করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ। এ ছাড়াও সারা দেশে শতাধিক ব্যবসায়ীকে আটকের খবর পাওয়া গেছে।
কিশোরগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় লবণের দাম বাড়ার খবরে খুচরা ও পাইকারি বাজারে ক্রেতাদের ভিড় বেড়ে যায়। প্রয়োজনে যারা আধা কেজি থেকে এক কেজি লবণ কিনতেন তারাও লাইন ধরে কিনে নিয়ে যান পাঁচ থেকে ১০ কেজি করে লবণ। ফলে গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার মধ্যেই বাজারের সব দোকানে লবণের মজুদ শেষ হয়ে যায়। এ সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ২০ টাকা কেজির মোটা লবণ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় এবং ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজির চিকন লবণ ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। এ অবস্থায় প্রশাসনের লোকজন ঝটিকা অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির দায়ে গতকাল বিকেলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের বড়বাজারে অজয় সাহা ও সুমন মিয়া নামে দুই লবণ ব্যবসায়ীকে দেড় লাখ টাকা জড়িমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাজারে সিন্ডিকেট করে বেশি দামে লবণ বিক্রি হচ্ছেÑ এমন খবরে এই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গালিব মাহমুদ পাশা।
ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরে লবণ কিনতে ভিড় লেগে যায় ক্রেতাদের। এ অবস্থায় গুজব প্রতিহত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামেন। তারা দোকানে দোকানে যেয়ে তদরকি করতে থাকেন। বাজারে লবণ ক্রেতাদের আশ্বস্ত করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের খবর পেয়ে কয়েকজন অসাধু দোকানি এ সময় দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যায়।
সরেজমিন শহরের চকবাজারের চালপট্টির মুদি দোকানসহ পাইকারি দোকানগুলোতে দেখা যায় বিকেল হতেই ক্রেতাদের ভিড়। এ সময় তাদেরকে দুই কেজি থেকে ১০ কেজি লবণ কিনতেও দেখা যায়। সেখানে ভাই ভাই স্টোরে লবণ কিনতে আসা একজন নারী জানান দোকানি তার কাছ থেকে এক কেজি লবণের দাম রেখেছেন ৮০ টাকা।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেট নগরীতে অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির দায়ে পাঁচটি দোকানে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়। গতকাল মঙ্গলবার নগরীর কাজিটুলা, আম্বরখানা ও শাহী ঈদগাহের পাঁচটি দোকানে এ জরিমানা করা হয়। এ অভিযান পরিচালনা করেন ভোক্তা অধিকার অধিদফতর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: ফয়জুল্লাহ।
এ দিকে, একই দিনে শাহপরান এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছেন ভোক্তা অধিকার অধিদফতর সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় বিভিন্ন অপরাধে বালুচর বিসমিল্লাহ স্টোরকে সাত হাজার টাকা, মেডিসিন স্টোরকে তিন হাজার টাকা ও নাহার মেডিসিন স্টোরকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা কেজি দরে লবণ বিক্রি হচ্ছেÑ এমন গুজবে লবণ ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে। এক দোকানে লবণ না পেয়ে অন্য দোকানে দৌড়াচ্ছে ক্রেতারা।
মাসুদুর রহমান নামের এক ক্রেতা জানান, প্রতিবেশীরা সবাই পাঁচ থেকে ১০ কেজি করে লবণ ক্রয় করেছে। দুই-এক দিনের মধ্যে প্রতি কেজি লবনের দাম দুই শ’ টাকা হয়ে যাবেÑ এমন খবরে তিনি তিনি ১০ কেজি লবণ ক্রয় করেছেন বলে জানান।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস জানান, লবণের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সঠিক নয়। এটি একেবারে গুজব। এ ব্যাপারে মাইকিং করে জনসাধারণকে সচেতন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, ফুলছড়ি উপজেলার সর্বত্র লবণের মূল্যবৃদ্ধির গুজব ছড়িয়ে পড়লে মুদি দোকানগুলোতে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ছোট ছোট দোকানগুলোতে নিমিষেই ফুরিয়ে যায় লবণের মজুদ। জনসচেতনতার জন্য দুপুরে গুজবে কান না দিতে ফুলছড়ি উপজেলা বণিক সমিতির পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। মুদি দোকানে হঠাৎ করে লবণ কিনতে সাধারণ মানুষের ভিড় করায় বিষয়টি নিয়ে জনমনে মুখরোচক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, কয়েক দিন ধরে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লবণের দাম বেড়ে গেছে বা যাবে এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়।
মঙ্গলবার সকালেই চার দিকেই ছড়িয়ে পড়ে পেঁয়াজের পর লবণের দাম বেড়ে গেছে। এমন খবর কোথায় শুনছেন, জানতে চাইলে জনসাধারণ জানান, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লবণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাই পেঁয়াজের দামের মতো লবণ বেশি দামে কেনার আগেই অনেকেই ৫ থেকে ১০ কেজি করে লবণ কিনে নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, হঠাৎ করে শুনি লবণের দাম বেড়ে গেছে। তাই বেশি দামে কেনার ভয়ে একসাথে ১০ কেজি লবণ কিনেছি।
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু রায়হান দোলন বলেন, লবণের কোনো ঘাটতি নেই। দামও বাড়েনি। এটা একটা গুজব। লবণের দাম বৃদ্ধির এই গুজব মোকাবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। যারা এ গুজব রটাবে বা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির জন্য মজুদ রাখবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কাশিয়ানী (গোপালগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ‘লবণ’ এর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সকাল থেকেই লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায় কাশিয়ানীর হাটবাজারে। এই সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বেশি দামে লবণ বিক্রি করে।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাব্বির আহমেদ ও সহকারী কমিশনার ভূমি মিন্টু বিশ্বাস এবং ওসি মোঃ আজিজুর রহমান বিভিন্ন হাটবাজারে গিয়ে বিষয়টি গুজব বলে সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন। বেশি দামে লবণ বিক্রি করায় কয়েকটি দোকানে তালা দেয় উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয়রা জানান, লবণের কেজি ২০০ টাকা হবে কাশিয়ানী উপজেলার বিভিন্ন হাটেবাজারে এমন গুজব হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে ৩০ টাকা কেজির লবণ ৮০ টাকায় বিক্রি শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।
কাশিয়ানী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘একটি চক্র গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে লবণ বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে। বিষয়টি জানার পরপরই সবাইকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করায় তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। বাজারে যথেষ্ট লবণ রয়েছে। কেউ গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মুকসুদপুর (গোপালগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে এমন খবরে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন খুচরা দোকানগুলোতে। বাড়তি চাপে নিমিষেই ফুরিয়ে যায় বিভিন্ন দোকানের লবণের মজুদ। উপজেলা শহর ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ১৫০ টাকা দরে লবণ কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। বেশির ভাগ মুদি দোকানেরই মজুদ ফুরিয়ে গেছে। ক্রেতাদের দাবি, লবণের দাম বাড়তে যাচ্ছে। তাই তারা লবণ কিনতে এসেছেন। তবে কোথায় এমন সংবাদ শুনেছেন এ কথা কেউ বলতে পারেননি।
ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে গুজবের সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মূল্যে লবণ বিক্রির অপরাধে তিন ব্যবসায়ীকে কারাদণ্ড প্রদান করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাশাপাশি আরো দুই ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার করে টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিরাজুল হক ও সারওয়ার হোসেন নামের দুই ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা করে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন এবং কালিবাড়ি বাজার থেকে মাসুদ, সিরাজুল ইসলাম ও নবাব নামের অপর তিন ব্যবসায়ীকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।
এর আগে সকাল থেকে শহরের কালিবাড়ি, শীবগঞ্জ ও বাসস্ট্যান্ড বাজারে গুজবের জেরে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাজারে লবণের কৃত্রিম সঙ্কট দেখা দিলে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
আমতলী (বরগুনা) সংবাদদাতা জানান, গতকাল দুপুরের পর থেকে লবণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার সর্বত্র। এ সুযোগে কোনো কোনো ব্যবসায়ী ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে লবণ বিক্রি শুরু করেন। আবার অনেক বিক্রেতা দোকানে লবণ নেই বলে ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেন। অপর দিকে লবণের দাম বেড়ে যাওয়ার গুজবে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিকেলে পৌরশহরসহ উপজেলার সর্বত্র মাইকিং করে জানানো হয়েছেÑ উপজেলায় পর্যাপ্ত লবণ মজুদ আছে। যারা গুজব রটাবে, যেসব বিক্রেতা লবণের দাম বেশি রাখবে ও মজুদ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় লবণের দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। প্রতি কেজি লবণের দাম কোথাও কোথাও দ্বিগুণ হয়েছে। এতে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা আরো দাম বাড়ার আশঙ্কায় লবণ কিনতে দোকানে ছুটছে।
বগুড়া শহরের ফতেহ আলী বাজার, রাজাবাজার, খান্দার বাজার, বকসী বাজার গিয়ে দেখা গেছে, লবণের দোকানে উপচেপড়া ভিড়। কোনো কোনো দোকান বিকেলেই লবণশূন্য হয়ে গেছে।
কাহালু সংবাদদাতা জানান, কাহালুতে অসাধু ব্যবসায়ীরা এক রাতের মধ্যে লবণের মূল্য তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সোমবার ছিল প্যাকেট লবণ প্রতি কেজি ৩৫ টাকা, যা গতকাল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫-৮০ টাকা এবং খোলা লবণ প্রতি কেজি ছিল ১৪ টাকা তা বেড়ে বিক্রয় হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়। অতিরিক্ত মূল্যে লবণ বিক্রয়ের অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাহালু বাজারের ব্যাবসায়ী ইসলাম আলীর পাঁচ হাজার টাকা ও মুক্তার হোসেনের দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ দিকে অভিযান শেষে নির্বাহী অফিসার চলে গেলে আবারো ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মূল্যে লবণ বিক্রয় করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া উপজেলার দুর্গাপুর বাজার, জামগ্রাম, মুরইলসহ বিভিন্ন স্থানে প্যাকেট লবণ ১০০ টাকা কেজি ও খোলা লবণ ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে।
সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, উপজেলার সর্বত্র লবণের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। খোলা লবণ প্রতি কেজি ২০-২৫ টাকা এবং প্যাকেট লবণ ৫০-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ হুমড়ি খেড়ে পড়েছে লবণের দোকানে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ জানান, গুজবের কারণে লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠানো হয়েছে। তিনি দাম বাড়ার গুজবে কান না দিতে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন।
নেত্রকোনা সংবাদদাতা জানান, লবণ নিয়ে নেত্রকোনা জেলায় লঙ্কাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চড়া দামে লবণ ক্রয় করতে শত শত নারী-পুরুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে।
সকাল থেকে ফেসবুক, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ায় যে, পেঁয়াজের মতো এবার লবণেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মুহূর্তে শত শত নারী-পুরুষ কাজকর্ম ফেলে লবণের খোঁজে ছুটতে থাকেন। খুচরা লবণের দোকানের সামনে প্রচণ্ড ভিড় জমাতে শুরু করে। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় দোকানিরা হকচকিত হয়ে পড়েন। অতি মুনাফার লোভে অনেক ব্যবসায়ী মজুদকৃত লবণ অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলতে শুরু করেন। তিন-চার ঘণ্টা এই অরাজক পরিস্থিতি চলার পর মোবাইল কোর্ট নেত্রকোনা মেছুয়া বাজারসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে। অনেক স্থানে মজুদকৃত লবণ আটক করা হয়। অতিরিক্ত দামে বিক্রি করার দায়ে ভোক্তা অধিকার আইনে অন্তত দেড় ডজন ব্যবসায়ীকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করা হয়। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে জেল-জরিমানার ভয়ে খুচরা লবণ ব্যবসায়ীরা দোকান রেখে পালিয়ে যান।
নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি মো: তাজুল ইসলাম বলেন, লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পড়ায় আগের দামেই এখন লবণ বিক্রি হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement