২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আবরার হত্যার চার্জশিট

২৫ আসামির সবাই ছাত্রলীগের ; ১১ জন সরাসরি জড়িত ; আছে বুয়েট প্রশাসনের ব্যর্থতা
আবরার হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিরা : নয়া দিগন্ত -

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যায় ২৫ জনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। একক কোনো কারণে নয়, বেশ কিছু কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এ হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং ১৪ জনের সম্পৃক্ততা দেখানো হয়েছে চার্জশিটে। অভিযুক্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি চারজন এখনো পলাতক। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে। হত্যার দায় স্বীকার করে আট আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। বাকি ১৩ জনের ১৬১ ধারায় জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ চার্জশিট জমা দেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হেমায়েত উদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, হত্যা মামলার আলামত হিসেবে আবরার ফাহাদের রক্তমাখা জামাকাপড়, মেসেঞ্জারে আসামিদের কথোপকথন এবং বুয়েট শেরেবাংলা হলের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ জব্দ দেখানো হয়েছে।
গত ৬ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। হত্যাকাণ্ডে ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন সন্ধ্যার পর চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করা হয়। নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদি হয়ে মামলাটি করেন। ঘটনার পরপরই হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় তদন্তসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা। এরপর আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ উদঘাটন করা সম্ভব হয় বলে দাবি তদন্তসংশ্লিষ্টদের।
এর আগে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আবরারকে হত্যায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন ১১ জন। তারাই আবরারকে কয়েক দফায় মারধর করেন। অন্য ১৪ জন বিভিন্নপর্যায়ে বিভিন্নভাবে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ৩১ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। ঘটনার দিন রাত ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত আবরারকে পেটানো হয়।
তিনি বলেন, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ হিসেবে একক কোনো কারণ খুঁজে পায়নি পুলিশ। অনেকগুলো বিষয়ের সমষ্টিতেই আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি হত্যায় জড়িতরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে। তারা সবাই উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরেকটু মনিটরিং করলে এই ঘটনা এড়ানো যেত। তদন্তে তাদের ব্যর্থতাও পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আমরা চার্জশিট দিচ্ছি। এজাহারভুক্ত ১৯ জনের বাইরে ঘটনার তথ্য প্রমাণে আরো ছয়জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এজাহারভুক্তদের মধ্যে ১৬ জন এবং এজাহারবহির্ভূত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আবরার ফাহাদকে মারধরে সরাসরি ১১ জন জড়িত ছিলেন। অন্যরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঘটনার পরিকল্পনা এবং নির্দেশনার সাথে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পৃক্ত।
মনিরুল ইসলাম বলেন, আসামিদের ভাষ্যমতে আবরার ফাহাদ দেখা হলে বড়দের সালাম দিত না। বিভিন্ন তির্যক মন্তব্য করত। আগে থেকেই তারা নানা কারণে আবরার ফাহাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। অনেক বিষয়ের সমষ্টিতেই আবরার ফাহাদকে পেটানো হয়। একজনকে মেরে অন্যজনকে শিক্ষা দিতে কিংবা জুনিয়রদের মধ্যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে তারা দীর্ঘ দিন ধরে র্যাগিংয়ের নামে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। যার আচরণ অপছন্দ হতো তাদেরকেই ডেকে এনে নানা নির্যাতন করা হতো।
ঘটনার দিন রাত ১০টার পর থেকে আবরার ফাহাদকে মারধর শুরু করা হয় জানিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, রাত আড়াইটার দিকে বুয়েটের ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হল-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরেকটু মনিটরিং করলে এ ঘটনা এড়ানো যেত। তদন্তে আমরা তাদের ব্যর্থতা দেখেছি। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা পুলিশের বিষয় নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাত ৩টার দিকে পুলিশকে খবর দেয়া হয়, শিবির সন্দেহে একজনকে আটক করা হয়েছে। এ সময় পুলিশের টহল টিম হলের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে; কিন্তু পরে জানানো হয়, সেখানে কিছু হয়নি। ৩টার আগে পুলিশ এ বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি।
এ দিকে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আবরার শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, এই সন্দেহেই তাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার আগে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা পরিকল্পনা করেন আবরারকে শায়েস্তা করার। ঘটনার আগে তারা একটি মিটিংও করেন। এর আগে বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা ফেসবুক গ্রুপে আবরারকে শায়েস্তা করার ঘোষণা দেন। এতে অনেকেই সায় দেন। তারপর আবরারকে গত ৬ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে এনে মারধর করা হয়। তাকে কিলঘুষি মেরে, স্কিপিং দড়ি দিয়ে ও ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটান হত্যাকারীরা। তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাকে পেটানো হয়। পানি পানি বলে চিৎকার করলেও তাকে পানি খেতে দেয়া হয়নি। আবরারকে পেটানোর একপর্যায়ে তিনি কয়েকবার বমি করেন; কিন্তু তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি কেউ। একপর্যায়ে গভীর রাতে আবরার মারা যাওয়ার পর তাকে ধরাধরি করে দোতলার সিঁড়ির ওপর ফেলে রাখেন হত্যাকারীরা।
এজাহারনামীয় গ্রেফতারকৃত আসামি ১৬ জন : মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা বুয়েটের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। তারা হলেনÑ মেহেদী হাসান রাসেল, মুহ্্তাসিম ফুয়াদ, মো: অনিক সরকার ওরফে অপু, মো: মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো: মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো: মাজেদুর রহমান ওরফে মাজেদ, মো: মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ হোসেন, মো: শামীম বিল্লাহ্্, মো: সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মো: মোয়াজ ওরফে মোয়াজ আবু হোরায়রা ও মুনতাসির আল জেমি।
এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ৩ জন : এজাহারনামীয় আসামিদের মধ্যে এখনো তিনজন পলাতক রয়েছেন। তারা হলেনÑ মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহ্্তেশামুল রাব্বি তানিম ও মো: মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম।
এজাহার বহির্ভূত তদন্তে প্রকাশিত গ্রেফতারকৃত আসামি ৬ জন : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, আবরার হত্যাকাণ্ডে এজাহারনামীয় আসামি ছাড়াও ছয়জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে গোয়েন্দারা। এরা সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকলেও তারা পরিকল্পনা এবং বিভিন্নভাবে হত্যায় সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারীরা। তারা হলেনÑ অমিত সাহা, মো: মিজানুর রহমান ওরফে মিজান, এস এম মাহমুদ সেতু, সামছুল আরেফিন রাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না ও মুজতবা রাফিদ। এর মধ্যে মুজতবা রাফিদ পলাতক।
হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১১ জন : বুয়েটছাত্র আবরারকে হত্যায় সরাসরি যে ১১ জন জড়িত ছিলেন তারা হলেনÑ মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, মো: অনিক সরকার ওরফে অপু, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো: মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো: মুজাহিদুর রহমান ওরফে মুজাহিদ, মো: শামীম বিল্লাহ, মো: সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহ্্তেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম ওরফে তানভীর।
এ দিকে মেহেদী হাসান রাসেল ও মুনতাসির ফুয়াদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও ঘটনার সাথে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এবং বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুনতাসির ফুয়াদ ঘটনার নেতৃত্ব ও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করেছে। এ ছাড়াও আবরার ফাহাদের লাশ শেরেবাংলা হলের দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে রাখার পর তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেয়ার জন্য মেহেদী হাসান রাসেল বুয়েটের ডাক্তারকে চাপ সৃষ্টি করে এবং উপস্থিত ছাত্র ও অন্যদের এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে নিষেধ করে। আবরারকে মারধরে ব্যবহৃত ক্রিকেট স্ট্যাম্পসহ অন্যান্য আলামত অপরাধীরা মুনতাসির ফুয়াদের ২০১০ নং রুমে রেখে দেয়।
যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন : আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত আট আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তারা হলেনÑ ইফতি মোশাররফ হোসেন সকাল, বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, অনিক সরকার, মো: মুজাহিদুর, মনিরুজ্জামান মনির, এ এস এম নাজমুস শাদাত ও তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর।
দুই দফায় মিটিং : আবরারকে হত্যার আগে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুই দফায় মিটিং করে। এতে সিদ্ধান্ত হয় আবরারকে ধরতে হবে। তাকে চেক করে শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে মেরে হল থেকে বের করে দিতে হবে। ৪ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টায় শেরেবাংলা হল ক্যান্টিনের মিটিংয়ে আটজন অংশ নেয়। তারা হলেন মেহেদী হাসান রবিন, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, অমিত সাহা, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না ও মুজতবা রাফিদ। ৫ অক্টোবর রাত ১০টায় শেরেবাংলা হলের গেস্ট রুমে আরেকটি মিটিংয়ে ছাত্রলীগের ১২ জন অংশ নেয়। তারা হলো মনিরুজ্জামান মনির, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, মুজতবা রাফিদ, অমিত সাহা, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, সামছুল আরেফিন রাফাত, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুহাম্মদ মোর্শেদ উজ জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, মুনতাসির আল জেমি, মো: মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম ও মো: সাদাত ওরফে এ এস এম নাজমুস সাদাত।
এ সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মামলাটির চার্জশিট দাখিলের আগে দুই দফা তার কাছে আনা হয়। চার্জশিট প্রস্তুতের পর সর্বশেষ মঙ্গলবার তার কাছে মতামতের জন্য আনা হয়েছিল। সাধারণত মামলার ধার্য তারিখে চার্জশিট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ওই দিন আদালত মামলার বাদিকে চার্জশিটের বিষয়ে কোনো আপত্তি আছে কি না তা জানতে তলব করতে পারেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement