২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
উপকূলে রাডার

ভারতের প্রযুক্তি দিয়ে কার ওপর নজরদারি করা হবে?

-

বাংলাদেশের উপকূলে ভারতের যে রাডার সিস্টেম বসাতে দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, তার ধরন এবং ব্যবহার কী হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে দু’শের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন সমুদ্রপথে আসা বিভিন্ন ধরনের হুমকি মোকাবেলায় এই রাডার-ব্যবস্থা দু’দেশের জন্যই কার্যকর হবে।
অন্য দিকে, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এই সহযোগিতা চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। ভারত অতীতে মরিশাস, সেশেলস ও মালদ্বীপে এ ধরনের রাডার-ব্যবস্থা স্থাপন করেছে। মিয়ানমারে একই ধরনের ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য আলোচনা চলছে।।
সমুদ্রপথে চীনের সামরিক গতিবিধি নজরে রাখার জন্য ভারত এই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে অন্যরা এই ব্যাখ্যাকে ‘ভয় বিক্রির চেষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে এই সমঝোতাস্মারক সই হয়। সমঝোতাস্মারকে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে যৌথভাবে একটি ‘কোস্টাল সার্ভিল্যান্স’ বা উপকূলীয় নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। তবে এই রাডার উপকূলের কোথায় স্থাপন করা হবে কিংবা এই ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে কারা থাকবে সে বিষয় এখনো অস্পষ্ট।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, রাডার-ব্যবস্থা স্থাপনের পর তার পরিচালনার দায়িত্বে কারা থাকবে সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাডার পরিচালনায় শুধু বাংলাদেশের লোকবল ব্যবহারের প্রস্তাব রয়েছে; কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে যৌথ লোকবল ব্যবহারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আলোচনা এখনো চলছে। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ তবে ভারতের নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও দিল্লির সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিজের পরিচালক কমোডোর উদয় ভাস্কর বলেন, এ ধরনের প্রকল্পে রাডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে লোকবল সাধারণত যৌথভাবেই সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে মরিশাস ও মালদ্বীপে রাডার-ব্যবস্থা স্থাপনের উদাহরণ তুলে ধরেন মি. ভাস্কর।
মি. ভাস্কর বলেন, ভারত মহাসাগর অঞ্চলের দেশগুলোকে উন্নত নজরদারিতে সক্ষমতা বাড়াতে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যার অংশ হিসেবে মরিশাস, সেশেলস, মালদ্বীপে রাডার-ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। রাডার-ব্যবস্থা স্থাপন করতে যেসব প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার হয় তার পুরোটাই ভারত থেকে সরবরাহ করা হবে।
মি. ভাস্কর বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অংশ হিসেবে এই মুহূর্তে ভারত রাডার ও অন্যান্য হার্ডওয়্যার বা যন্ত্রপাতি যা দরকার হবে তার সব কিছুই সরবরাহ করবে। আর এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করবে।’ ‘রাডার-ব্যবস্থা স্থাপনের পর একটি প্রসারণ কেন্দ্র বা ডিফিউশন সেন্টার তৈরি করা হবে। যেখানে সব দেশ তাদের সামুদ্রিক নজরদারি সম্পর্কে (ইনপুট ডোমেইন অ্যায়ারনেস) তথ্য দেবে।’ এ ধরনের একটি কেন্দ্র দিল্লির কাছে গুরুগাম নামে জায়গায় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মি. ভাস্কর বলেন, রাডার-ব্যবস্থা বঙ্গোপসাগরে কী ধরনের কার্যক্রম হচ্ছে তার ওপর নজরদারি করতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতকেও সুযোগ দেবে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে নজরদারি বাংলাদেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ সেসব এলাকায় নজরদারি সম্ভব হবে।
এ সম্পর্কে মিস্টার ভাস্কর বলেন, অপরাধমূলক যেকোনো ধরনের কর্মকাণ্ড এই নজরদারির আওতায় আসবে এবং এ সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করা হবে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হতে পারে সাগরে অবৈধ মাছ ধরার বিষয়ে তথ্যবিনিময়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের জেলেদের কাছে মাছ ধরার উন্নত প্রযুক্তিসংবলিত ট্রলার বা নৌযান না থাকার কারণে গভীর সমুদ্রে যেতে পারে না তারা। আর এই সুযোগ নেয় বিদেশী জেলেরা, যা কাক্সিক্ষত নয়। এগুলো স্থানীয় জেলেদের নিরাপত্তার জন্য বাধা বটে। এগুলো নজরদারি করা হবে।’ বাংলাদেশের উপকূলে অবৈধভাবে মাছ ধরার নৌযান অনুপ্রবেশ ছাড়া আর কোনো বড় ধরনের হুমকি সাধারণত এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সাগরে পাইরেসি বা জলদস্যুদের একটা হুমকির কথা বলা হলেও তা এ অঞ্চলে খুব কম বলে জানান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তাহুমকির মধ্যে রয়েছে পাইরেসি বা দস্যুতা, বিশেষ করে বন্দর এলাকায় চুরি ও ডাকাতি বড় সমস্যা।
জনাব আহমেদ বিবিসিকে বলেন, ‘এ ছাড়া বেআইনিভাবে মাছ শিকার, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি, বিদেশী ট্রলারের অনুপ্রবেশ ও অবৈধ মাছ শিকার, বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই দেখা যায়’। ‘এসব বিষয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। তবে দূরবর্তী হুমকি, যেমন : বিদেশী আগ্রাসী শক্তি। তবে আজকাল এ ধরনের হুমকির চিন্তা কেউ করে না যে, এ ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। তবে দু’দেশের সীমান্ত যে এলাকা রয়েছে সেখানে কিছুটা হুমকি থাকতে পারে।’ ‘এ ছাড়া রয়েছে, অবৈধ পণ্যের পাচার, মাদক, অস্ত্র এবং মানবপাচারও হয়ে থাকে মাঝে মাঝে সাগর পথে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বাইরের দেশের কিছু মাছ ধরার নৌযান বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের উপকূলে অনুপ্রবেশ করে, যা নৌবাহিনী আটক করে। থাইল্যান্ড থেকে এসব নৌযান বেশি আসে। তবে মিয়ানমারের নৌযানও মাঝে মাঝে আসে।’ এ ছাড়া আর বড় ধরনের কোনো হুমকি এখনো রিপোর্টেড হয়নি এবং আসবে বলেও মনে হয় না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেআইনিভাবে চলাচলকারী জাহাজ ও নৌযানের ওপর নজরদারি করা সম্ভব হবে এই ব্যবস্থায়। বিভিন্ন দেশের জাহাজ যা আইনসম্মতভাবে চলাচল করে; কিন্তু তাদের সাথে যোগাযোগ না থাকলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যবস্থায় এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে জাহাজ চলাচল নিরাপদ করা সম্ভব হবে।
মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘তবে কেউ যদি মনে করে যে, বাইরে থেকে কোনো যুদ্ধজাহাজ এলো কি না, এ ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। আর ঘটলেও তারা বলে কয়ে আসে, লুকিয়ে-চুরিয়ে আসা খুব একটা ঘটে না।’ জনাব আহমেদ বলেন, ভারত-বাংলাদেশ মিলে অন্য দেশের এ ধরনের জাহাজ আসা ঠেকিয়ে দেবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ এটা আসলে খুবই দূরবর্তী একটা চিন্তা।
চীনের ওপর নজরদারি বিষয়ে জনাব আহমেদ বলেন, চীন এ অঞ্চলে তেমন আসে না। কিছু মানুষ ভয় বিক্রির চেষ্টা করছে এ ধরনের মন্তব্য করে।
তিনি বলছেন, ‘এ অঞ্চলে ভারতের এবং মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ আসা-যাওয়ার ঘটনাই বেশি। অন্য কেউ এলেও জানিয়ে আসে, অতিথি বা বন্ধুত্বপূর্ণ সফরে আসে। এই ব্যবস্থার লক্ষ্য সেগুলো হতে পারে। তবে হলেও খুব কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি না।’ তবে আরেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন ভিন্ন মত দিয়েছেন।
তিনি বলেন, কৌশলগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এ ধরনের রাডার শুধু বাংলাদেশ নয়; বরং মরিশাস ও সেশেলস-সহ আরো কয়েকটি দেশে বসিয়েছে।
‘আন্দামানে ভারত একটি নেভাল এয়ারবেজ করেছে। এই দ্বীপপুঞ্জটি চীনের জাহাজগুলো মিয়ানমারে আসার পথের খুব কাছাকাছিতে অবস্থিত। আর তাই আসলে চীনের গতিবিধি নজরদারিতে আনার জন্য ভারত সেই সেশেলস থেকে এটা করে আসছে।’ মালবাহী জাহাজের চলাচল ছাড়া অন্যান্য জাহাজের গতিবিধির ওপরও নজরদারি করা হবে বলে তিনি মনে করেন।
তার মতে, ‘ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র উঠতি শক্তি হিসেবে যে একটি কৌশলগত প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে তার একটি উপাদান হতে পারে এটি’।
জেনারেল হোসেন বলেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান মিলে বঙ্গোপসাগরে একটি আন্ডার-ওয়াটার সার্ভিইল্যান্স সিস্টেম বা পানির নিচে নজরদারিব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। এই নজরদারিব্যবস্থা যুক্ত হবে কোস্টাল সার্ভিইল্যান্স সিস্টেমের সাথে। ‘তাই সহজেই বলা যায় যে এর মূল উপলক্ষ চীন’। এই পদক্ষেপ চীনের সাথে বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে শঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ডোকলাম ও অরুণাচলে ভারত-চীন যে সামরিক প্রতিযোগিতা চলছে তার অংশ হিসেবে সে অঞ্চলে একধরনের সামরিক কোর তৈরি করেছে ভারত। বঙ্গোপসাগরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এই জায়গাতে গিয়ে আমরা চীন-ভারতের কৌশলগত টানাপড়েনের মধ্যে পরে যাচ্ছি’। তিন দিকে পরমাণু শক্তিধর তিন রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান-চীন দ্বারা বেষ্টিত হয়ে এ ধরনের টানাপড়েনে জড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশের চিন্তার অবকাশ আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনাকে চীন অবশ্যই নেতিবাচকভাবে নেবে। চীন যেহেতু দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেয়, অর্থাৎ তারা অ্যাকশনে রিয়্যাকশন করে, তাই তারা কী প্রতিক্রিয়া দেবে তা বলা মুশকিল হলেও এই পদক্ষেপে চীন খুব খুশি হবে বলে আমি মনে করি না।’ ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় এই রাডার সিস্টেম কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মি. ভাস্কর বলেন, ‘প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা শুধু ভারত নয়; বরং বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হবে’।
একই প্রসঙ্গে ভারতের আরেক সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি বলেন, ‘এটা ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে কিছুটা হয়তো শক্তিশালী করল বা এখন যা বন্দোবস্ত আছে তার সাথে কিছুটা হয়তো যুক্ত হলো’। তবে এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে জোরদার করার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জেনারেল ব্যানার্জি বলেছেন, ‘আসল নজরদারির বিষয়টি রাডার নয়; বরং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে করা হয়’।
সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একে অপরের সাথে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে এ অঞ্চলের দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি থাকলে সে সম্পর্কিত তথ্যগুলোও বিনিময় করা হয়। রাডার-ব্যবস্থা স্থাপনের পর কোনো ধরনের সন্ত্রাসী হামলার হুমকি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া গেলে সেগুলোও বিনিময় করা হবে বলেও জানান তিনি।
তবে রাডার-ব্যবস্থা স্থাপনের পর যেসব তথ্য বিনিময় করা হবে তার মধ্যে হোয়াইট শিপিং বা বৈধভাবে পণ্য পরিবহনের জন্য বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বিষয়েই সবচেয়ে বেশি তথ্য থাকবে। তবে সমঝোতাস্মারকে বলা হয়েছে যে, সমুদ্রপথে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী হামলার প্রচেষ্টা সম্পর্কেও আগে ভাগেই জানা যাবে এই নজরদারিব্যবস্থার মাধ্যমে।
উদাহরণ হিসেবে সেখানে বলা হয় যে, মুম্বাই হামলার মতো কোনো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা তৈরি হলে সে সম্পর্কেও আগে থেকেই খবর পাওয়া যাবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে।


আরো সংবাদ



premium cement