২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মোহামেডানসহ ৬ ক্লাবে অভিযান

ক্যাসিনো ও জুয়ার সরঞ্জাম উদ্ধার; থমথমে স্পোর্টস ক্লাব এলাকা; ‘অভিজাত’ ক্লাবগুলো চলছে নির্বিঘেœ
মোহামেডান ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে পুলিশের অভিযান : নয়া দিগন্ত -

রাজধানীর ক্লাবগুলোতে এবার অভিযানে নেমেছে পুলিশ। মতিঝিল এলাকার চারটি এবং বাড্ডার দু’টি ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ৩টায় মতিঝিল ক্লাবপাড়ার মোহামেডান, আরামবাগ, দিলকুশা ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে তল্লাশি শুরু হয়। অভিযানে ক্লাবগুলো থেকে ক্যাসিনো ও জুয়ার বিপুল সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। তবে এ সময় কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বলছে, কয়েক দিন ধরে অভিযান চলার কারণে ক্লাবের লোকজন গা ঢাকা দিয়েছেন। ক্লাবগুলোর মালিকদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ দিকে বাড্ডার ইস্ট-ওয়েস্ট ও জাগরণী ক্লাবে গত শনিবার রাতে পৃথক অভিযান চালিয়ে ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে রাজধানীর স্পোটর্স ক্লাবগুলোতে। তবে গুলশান-বনানী এলাকার ক্লাবগুলোর মধ্যে কয়েকটি বন্ধ থাকলেও ‘অভিজাত’ হিসেবে পরিচিতগুলো চলছে আগের মতোই।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, গতকাল রোববার বিকেলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য আরামবাগ ক্রীড়া সঙ্ঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ঘিরে রাখেন। এ সময় ওই এলাকায় যানবাহন চলাচল সীমিত করে দেয়া হয়। নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। যদিও অভিযানের সময় ক্লাবগুলো ছিল বন্ধ। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা ক্লাবের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে কাউকে পাওয়া না গেলেও পাওয়া যায় জুয়া খেলা ও ক্যাসিনোর বিপুল পরিমাণ সামগ্রী।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার শিবলী নোমান জানান, গতকাল বিকেল থেকে পুলিশ মতিঝিল-আরামবাগ এলাকার চার ক্লাবে একযোগে অভিযান চালায়। ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, আগে থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা, অন্ধকারে সব কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে সেখানে ক্যাসিনো চলে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, অভিযানের খবর শুনে সবাই পালিয়ে যায়। দিলকুশায়ও কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি আরো বলেন, অভিযানে ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার ৯টি বোর্ড, এক লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ তাস, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে। মোহামেডানে পাওয়া গেছে দুটো রুলেট টেবিল, ৯টি বোর্ড, বিপুল পরিমাণ কার্ড, ১১টি ওয়্যারলেস সেট ও ১০টি বিভিন্ন ধরনের চাকু। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেট টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, যখনই আমাদের কাছে জুয়া ও ক্যাসিনো সম্পর্কে তথ্য এসেছে, তখনই আমরা অভিযান চালিয়েছি।
এর আগে, শনিবার রাতে বাড্ডার ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাব ও জাগরণী ক্লাবে অভিযান চালায় বাড্ডা থানা পুলিশ। ওই অভিযানে ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাব থেকে তিন যুবলীগ নেতাসহ ১৬ জনকে আটক করে পুলিশ। জানা গেছে, ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাবে দীর্ঘ দিন ধরে জুয়াবোর্ড পরিচালনা করতেন ৯৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: উজ্জল। অভিযানের সময় উজ্জল পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান। আটকরা হলেনÑ ৯৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি আলম, ৯৭ নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দুলাল ও যুবলীগ নেতা আয়নাল। এ ছাড়া সিদ্দিকুল, আলমগীর, সেলিমকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিদের নাম জানা যায়নি। অন্য দিকে জাগরণী ক্লাবে অভিযান চালিয়ে কাউকে পায়নি পুলিশ। এ ব্যাপারে বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাব ও জাগরণী ক্লাবে বাড্ডা থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬ জুয়াড়িকে আটক করেছে। তাদের আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরই ছাত্রলীগের পদ হারান শোভন-রাব্বানী। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। শুক্রবার যুবলীগের অপর আলোচিত নেতা জি কে শামীমকে নিকেতনের নিজ কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ আটক করা হয়। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে আটক করে র্যাব। শামীমের সাথে তার সাত দেহরক্ষীকেও আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত)। এর মধ্যে তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকা ও ২৫ কোটি টাকা তার নামে।
শুক্রবার রাতেই র্যাবের অভিযান পরিচালিত হয় রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাবে। আটক করা হয় ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে। অভিযানের সময় শফিকুলের কাছে সাত প্যাকেট গন্ধহীন হলুদ রঙের ইয়াবাসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া জব্দ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ক্যাসিনোতে খেলার কয়েন, স্কোরবোর্ড ও ৫৭২ প্যাকেট তাস। র্যাবের ধারণা, এ ক্লাবে ক্যাসিনো খেলা হতো। ওই রাতেই রাজধানীর ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেটি বন্ধ থাকায় সেখানে থাকা বারটি সিলগালা করে দেন র্যাব সদস্যরা।
অন্য দিকে শনিবার চট্টগ্রামের পাঁচটি ক্লাবে একযোগে অভিযান শেষে তিনটি ক্লাবে জুয়ার আসর চালানোর প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয় র্যাবের পক্ষ থেকে। মতিঝিলে শুরু হওয়া এই অভিযান রাজধানী ছাড়িয়ে এরই মধ্যে দেশের অন্য শহরেও বিস্তৃত হয়েছে। এতে দেশের ক্লাবপাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর সবচেয়ে বেশি স্পোর্টিং বা খেলাধুলার ক্লাব থাকায় মতিঝিল ‘ক্লাবপাড়া’ হিসেবেই পরিচিত। এই এলাকার ক্লাবগুলোর রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। তবে এসব ক্লাবের অনেকটিতে আড়ালে জুয়া চলে। র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মতিঝিলের সোনালী অতীত ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সঙ্ঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, পল্টনের ঢাকা রেস্টুরেন্ট এবং রিক্রেশন সেন্টারে ক্যাসিনো ও জুয়া হতো। তবে গত শনিবার দিনব্যাপী মতিঝিল ও পল্টনের ক্লাবপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ক্লাবগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ। দুই-একটি খোলা থাকলেও সেখানে আগের মতো ভিড় নেই। সন্ধ্যায় বাতি জ্বালানোরও কেউ নেই। শুক্রবার ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। বর্তমানে সেখানে পুলিশ পাহারা রয়েছে। ইয়ংমেনসেরও অবস্থা একই। সিলগালার পর রয়েছে পুলিশ পাহারায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা জানান, সাধারণ কেউ আর ভেতরে ঢুকতে পারছেন না।
গুলশান ও বনানী ক্লাব খোলা : বনানীর ‘এফ’ ব্লকের ১ নম্বর রোডে অবস্থিত বনানী ক্লাবের ছয় তলা ভবনের পুরোটাই শনিবার রাতে খোলা থাকতে দেখা গেছে। সামনে দুইজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত রয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি গেটের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে এবং নিরাপত্তাকর্মীরা গাড়ির দরজা খুলে তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন ভেতরে প্রবেশকারীদের নাম এন্ট্রি করছেন। বনানী ক্লাবের সিকিউরিটি ইনচার্জ মো: মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এই ক্লাবের সদস্য ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারেন না।’ তিনি বলেন, ক্লাবটিতে সুইমিং পুল, রেস্টুরেন্ট ও জিমনেশিয়াম রয়েছে। তবে কোনো বার বা ক্যাসিনো নেই। এখানে কোনো জুয়া খেলাও হয় না। তা ছাড়া অসামাজিক কোনো কার্যকলাপও এখানে হয় না। গুলশান ক্লাবের সামনে অসংখ্য গাড়ি পার্কিং অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে শনিবার রাতে। পুরো ক্লাবটি আলোয় ঝলমল করছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্লাবের সদস্যরা ভেতরে প্রবেশ করছেন।


আরো সংবাদ



premium cement