১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শাসক দলে সঙ্কট ও নতুন দল গঠনে কতটা প্রভাব পড়বে তুরস্কের রাজনীতিতে?

বাম থেকে : প্রেসিডেন্ট এরদোগান, আব্দুল্লাহ গুল, আলি বাবাজান এবং আহমেদ দাওতুলু -

গত ১৩ সেপ্টেম্বর একে পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন দলের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী (২০১৪-১৬) আহমেদ দাওতুলু এবং তার কাছের কয়েকজন নেতা। যদিও এই পদত্যাগটা প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ,পদত্যাগের কয়েক দিন আগে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বেশ কিছু কারণে তাকেসহ চারজনকে বহিষ্কার করার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দলের শৃঙ্খলা কমিটির কাছে প্রেরণ করেছিল। একে পার্টির নিয়মানুযায়ী কাউকে বহিষ্কারে (কিংবা যেকোনো শাস্তি দেয়ার জন্য) দলের শৃঙ্খলা কমিটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে অভিযোগকৃত ব্যক্তি অভিযোগের বিষয়ে জবাব দেয়ার সুযোগ পায়। এ ক্ষেত্রে দাওতুলু পদত্যাগ না করলে এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মাস খানেকের মধ্যেই তাকে বহিষ্কার করার সম্ভাবনা ছিল।
দল থেকে পদত্যাগ করার সময় সংবাদ সম্মেলনে তিনি স্পষ্টতই আরেকটি নতুন দল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এ দিকে দলের গুরুত্বপূর্ণ আরেক নেতা এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের নানা পদ তথা উপপ্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রীর (২০০২-২০১৫) দায়িত্ব পালন করা আলি বাবাজানও কয়েক দিন আগে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনিও ২০২০ সালের আগেই আরেকটি দল প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে, এই দলের পেছনে সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল রয়েছেন। বাস্তবিক অর্থে যদিও দল দুটো প্রতিষ্ঠার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে মাত্র কয়েক দিন আগে জানানো হয়েছে, কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরেই এগুলো নিয়ে দুই গ্রুপই কাজ করছিল। প্রথম দিকে যৌথভাবে কাজ করে একটি দল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ছিল, যা নানা কারণে আলোর মুখ দেখেনি। ধারণা করা হচ্ছেÑ আব্দুল্লাহ গুলের সাথে আহমেদ দাওতুলুর মানসিক দূরত্বই এর অন্যতম কারণ। ২০১৪ সালে আব্দুল্লাহ গুল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে দলে ফেরার পথে আহমেদ দাওতুলু অন্যতম বাধা ছিলেন বলে প্রচলিত আছে। উল্লেখ্য, সে সময় প্রেসিডেন্টরা নিরপেক্ষ হতেন। ২০০৭ সালে আব্দুল্লাহ গুল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কারণে দল থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
পরিকল্পিত দু’টি দলের মধ্যে দাওতুলুর দলটি তুলনামূলক রক্ষণশীল এবং আলি বাবাজানের দলটি উদারধারার হিসেবে গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। দ্বিতীয় দলটি আব্দুল্লাহ গুলের মাধ্যমে পশ্চিমাদের সহায়তা পাওয়ার কথা লোকমুখে ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে, আর দাওতুলুর টার্গেট রক্ষণশীল মুসলিম ভোটগুলো। তাতে কতটা প্রভাব পড়বে প্রেসিডেন্ট এরদোগান তথা একে পার্টির রাজনীতিতেÑ এ নিয়ে বেশ কয়েকটি জরিপ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ জনগণের মাঝে আছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এখন পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীনদের কিছু ভোট ভাগ হয়ে গেলেও বড় কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম; যদিও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর বড় কারণ, এখনো তুরস্কের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দ্বিতীয়ত, দুই গ্রুপ মিলে একটি দল গঠিত হলে প্রভাবটা আরো একটু বেশি পড়ত, এখন দুই দল হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় শুরুতেই কম গুরুত্ব পাবে। যদিও আগামী নির্বাচন হতে এখনো অনেক দেরি এবং এর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। বর্তমান জরিপ ও বিশ্লেষণগুলোকে যদি সামনে রাখি, তবে দুই দল মিলে কমবেশি ৭-১০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে; যার কিছু অংশ অন্য দলগুলো থেকেও আসবে। জরিপগুলো ভোটের অঙ্কে আলি বাবাজান কর্তৃক প্রস্তাবিত দলকেই এগিয়ে রাখছে। কারণ, সিরিয়া ও উদ্বাস্তু বিষয়ে দাওতুলুর ইমেজ মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ; যার প্রভাব পড়বে তার পরিকল্পিত দলের ভোটের খাতায়। আর বাবাজান দীর্ঘ দিন অর্থমন্ত্রীর পদে থাকায় এবং পশ্চিমা জগতের বিত্তবানদের সাথে তার সম্পর্কের কারণে অর্থনীতি চাঙা হবে ভেবে লিবারেল ভোটগুলোর একটি অংশ তার দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগামী নির্বাচনের আগে মূল বিষয় হিসেবে দাঁড়াতে পারে অর্থনীতি। গত এক-দেড় বছরে তুরস্কের অর্থনীতি যেভাবে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে এরদোগান যদি অর্থনীতির চাকার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন, তবে এই দুই দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা অনেকটাই তার জন্য সহজ হয়ে যাবে। সে লক্ষ্যেই এখন তিনি ছুটে চলেছেন। সম্প্রতি সুদের হার কমানো হয়েছে। তাতে আশ্চর্যজনকভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার দরপতন হয়েছে। গত এক বছরে সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিলেই বৈদেশিক মুদ্রার দাম ঊর্ধ্বমুখী হতো। অর্থনীতির পাশাপাশি এরদোগানের হাতে আরো কয়েকটি বড় পরিকল্পনা তথা প্রজেক্ট রয়েছে। যেমন : এস-৪০০ প্রযুক্তি পুরোপুরি স্থাপনসহ প্রতিরক্ষা খাতকে এগিয়ে নেয়া, ২০২৩ সালের মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন গাড়ি বাজারজাত করা এবং সিরিয়া সীমান্তে নিরাপদ জোন করে সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের সেখানে পুনর্বাসন করা। এই তিনটি বড় প্রজেক্টের কাজ ইতোমধ্যে চলমান এবং পরিকল্পনা মাফিক সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে এরদোগানের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে বলে আমি মনে করি। তাতে করে তিনি আগামী নির্বাচনের তরী সহজেই পার হতে পারবেন। আর ২০২৮ সাল পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। উল্লেখ্য, আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেটাই হবে তার শেষ মেয়াদ।
এবার আসি সম্ভাব্য এই নতুন দুই দল ডান তথা ইসলামপন্থীদের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে? গত মার্চ মাসের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল সেক্যুলার সিএইচপি ইস্তাম্বুল ও আনকারাসহ ১১ সিটিতে জয়লাভ করে বর্তমানে বেশ চাঙা অবস্থায় আছে। এর মধ্যে ইসলামপন্থীদের এই ভাঙন সত্যিই উদ্বেগজনক। দল দুটোর কার্যক্রম শুরু হলে ইসলামপন্থী রাজনীতির সমর্থক এমন দল সংখ্যা পাঁচটিসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দল মোট আটটি হবে। উল্লেখ্য, গত বছর সাদাত পার্টির একটি অংশ ভেঙে নয়া রেফা পার্টি নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তুরস্কে ইসলামী রাজনীতির পুরোধা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ছেলে ড. ফাহিত এরবাকান ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে এবং বর্তমানে তৃণমূলে সংগঠন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর জাতীয়তাবাদীদের রয়েছে তিনটি ধারা। সব মিলে আদর্শিক দিক চিন্তা করলে এই আটটি ডানপন্থী দলের বিপরীতে থাকবে সেক্যুলারদের একক দল, যা ডানপন্থীদের রাজনীতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাবে। যদিও ডানপন্থী ও ইসলামপন্থী দুয়েকটি দল বর্তমানে সেক্যুলারদের সাথে জোটে রয়েছে।
সব মিলে তুরস্কের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে, এখানে (একক) ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটি সংস্কৃতি দেখা যায়। তাতে এরদোগান গত ১৭ বছর যেভাবে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তাতে এরদোগান পরবর্তী তুরস্কের নেতৃত্ব নিয়ে ভাবতে হবে। এটাও ভাবনার বিষয় যে, তুরস্কের রাজনীতি ভবিষ্যতে কি ইসলামপন্থী ডানদের হাতে থাকবে নাকি সেক্যুলার বামরা দেশটির নেতৃত্বে চলে আসবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement