১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিয়ানমারে গণহত্যার উদ্দেশ্যেই রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ : জাতিসঙ্ঘ

-

সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্মূল করতে গণহত্যার অভিপ্রায় থেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন করে। জাতিসঙ্ঘের এক রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে সেনা অভিযান নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসঙ্ঘের তদন্ত রিপোর্টে এমন উপসংহার টানা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘শত শত রোহিঙ্গা নারী ও মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তথ্য প্রমাণ বলছে, ধর্ষণের ৮০ শতাংশ ঘটনাই ইচ্ছা করে ঘটানো হয়েছে। গণধর্ষণের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার ৮২ শতাংশের দায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর।’
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে কয়েকটি সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলায় নয় পুলিশ নিহত হওয়ার পর রাজ্যে বিশেষ করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সেনা অভিযান শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে সেখানকার প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়। পালিয়ে আসা ওইসব রোহিঙ্গার অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বা শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে আসেন। নারীদের শরীরে গণধর্ষণের শিকার হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। পালিয়ে আসা ওই সব মানুষের অভিযোগ ছিল, সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায় এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করছে।
অভিযোগ তদন্তের জন্য ওই বছরই জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল বিভিন্ন দেশের তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তদল গঠন করে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টে আরো বলা হয়, মিয়ানমার সরকার গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত কাউকে আটক করতে ব্যর্থ হয়েছে। গণহত্যার অভিযোগ উঠা ব্যক্তিদের ‘জেনোসাইড কনভেনশন’র অধীনে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি প্রদানে ব্যর্থতার দায় মিয়ানমার সরকারের।
মিয়ানমার সরকার শুরু থেকেই রাখাইন রাজ্যে বেসামরিক মানুষদের থওপর দমন-নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ সুযোগ তারা কাউকে দেয়নি। এমনকি, জাতিসঙ্ঘের তদন্ত দলকেও রাখাইন রাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।
যে কারণে তদন্ত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান, গবেষক এবং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সাথে কথা বলে এই তদন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়, ‘২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকেই রাখাইনে নারী ও মেয়েদের ওপর যৌন সহিংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করতেই সেখানে গণধর্ষণ চালায়। যুক্তিসঙ্গতভাবেই একে গণহত্যার ষষ্ঠ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে আমরা আমাদের রিপোর্টের ইতি টানছি।’
বিপুল সংখ্যায় এবং বেছে বেছে নারী ও মেয়েদের হত্যা, সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারী ও মেয়েদের বেছে বেছে ধর্ষণ, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ছোট শিশুদের ওপর আক্রমণ, নারীদের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত এবং শরীর, বিশেষ করে গাল, গলা, স্তন ও উরুতে কামড়ের দাগ দেখে তারা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা।
রাখাইনে গণহত্যা চালানোর দুই বছর হতে চললেও এখন পর্যন্ত এর জন্য দায়ী কোনো সেনা কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার ‘জঘন্যভাবে নিজেদের দায় অস্বীকার করেছে’।
জাতিসঙ্ঘের তদন্ত রিপোর্টে দুই শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্তের আহ্বান জানানো হলেও তারা এখনো স্বদর্পে নিজেদের পদে বহাল আছেন। মিয়ানমারের ওই দুই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তাদের নাম গোপন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, মিয়ানমারে কাচিন ও শান রাজ্যে সেনাসদস্যরা সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর জনগণের ওপর যৌন সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে। এই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানায় সংস্থাটি।
২০১৬ সালে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় আসে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকার। জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহী গোষ্ঠী, সামরিক ও বেসামরিক সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অগ্রাধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন তিনি। তবে ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চল, শান রাজ্য ও উত্তরের কাচিন রাজ্যে জাতিগত সঙ্ঘাত বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাত লাখেরও বেশি মানুষ। সু চিও তার ভূমিকার জন্য বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়েছেন। হারিয়েছেন বিভিন্ন পদক আর সম্মাননা।
জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টে বলা হয়, সেনাসদস্যরা নিয়মিতই কাঠামোবদ্ধভাবে ধর্ষণ, সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং নারী, পুরুষ, রূপান্তরকামীদের বিরুদ্ধে অন্যান্য যৌন সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড করে আসছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় কাচিন ও শান রাজ্য এবং পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার শত শত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করে। এতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর যৌন সহিংসতা ‘বেসামরিকদের সাজা দিতে এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে একটি ইচ্ছাকৃত, পূর্বপরিকল্পিত কৌশল।’
জাতিসঙ্ঘ মিশন জানায়, ২০১৮ সালে মানবাধিকার পরিষদে দেয়া রিপোর্টটিতে তারা নিজে থেকেই আরো সংযোজন করতে চেয়েছে যেন অন্যায়কারীরা সাজা পায়। তারা জানায়, এই রিপোর্টটির মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।


আরো সংবাদ



premium cement