১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছেলেধরা সন্দেহে ১৬ জনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

মহিলাকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন
-

হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, নাটোরের সিংড়া, ঝালকাঠি, বগুড়া, রাজশাহী ও সাভারে ১৬ জনকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। গণপিটুনি দেয়া অপর একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের বৈরাগীর বাজার এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে ছেলে ধরা সন্দেহে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নের বৈরাগীর বাজারে গতকাল সকালে এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ঘুরতে দেখে ছেলেধরা সন্দেহে আটক করা হয়। পরে একটি গাছের সাথে বেঁধে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোলা বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করেছে। ওই নারী মূলত মানসিক ভারসাম্যহীন।
গাবতলী (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, বগুড়ার গাবতলীতে ছেলে ধরা সন্দেহে চার যুবককে গণপিটুনি দিয়ে তাদের ব্যবহৃত একটি পিকআপ ভ্যান আগুনে পুড়িয়ে ভস্মীভ‚ত করেছে স্থানীয় জনতা। গাবতলীর ইউএনও আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী, সহকারী পুলিশ সুপার (গাবতলী সার্কেল) সাবিনা ইয়াসমীন ও থানার ওসি সেলিম হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওই চার যুবককে উদ্ধার করতে গেলে জনগণের রোষানলে পড়েন। এ সময় জনতার ইট পাটকেলে চার পুলিশসদস্য আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং ১৫ জনকে আটক করে। গতকাল উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়ন পরিষদের পূর্বপাশে স্কুলের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, আটক ওই চার যুবক গতকাল বিকেল ৩টায় দুর্গাহাটা মাদরাসা ও ইউনিয়ন পরিষদের পূর্বপাশে একটি কেজি স্কুলের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। স্থানীয় লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা এলোমেলো কথা বলে। তখন লোকজন ওই চার যুবককে ছেলে ধরা সন্দেহে মারধর শুরু করে। মুহূর্তে শতশত উৎসুক জনতার সমাগম ঘটে। একপর্যায়ে স্থানীয় জনতা তাদের ব্যবহৃত একটি পিকআপ ভ্যান আগুনে পুড়িয়ে দেয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মিঠু ওই চার যুবককে ইউনিয়ন পরিষদ রুমে আটক করে রাখে। আটককৃতরা হলোÑ গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়নের কর্নিপাড়া গ্রামের হযরত আলী প্রাং এর ছেলে ফাহিম প্রাং (২৪), পারধুনট মধ্যপাড়া গ্রামের আ: রশিদের ছেলে লুৎফর রহমান (৩৫), ধুনট জোড়শিমুল গ্রামের নজির হোসেনের ছেলে দুলাল হোসেন (২২) ও তার ভাই নিয়ামুল হোসেন (৩৬)। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং ১৫ জনকে আটক করে।
সিংড়া (নাটোর) সংবাদদাতা জানান, নাটোরের সিংড়ায় ছেলেধরা সন্দেহে আলী আহমদ নামের এক যুবককে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকাবাসী। গত রোববার সন্ধ্যায় সিংড়া পৌর শহরের মহেশচন্দ্রপুর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। আটক যুবক পরশুরামপুর থানার বেরাবাড়িয়া গ্রামের মৃত নছের আলীর ছেলে।
জানা গেছে, রোববার সন্ধ্যায় পৌর শহরের মহেশচন্দ্রপুর এলাকায় একজন উদ্ভট প্রকৃতি যুবককে ঘুরতে দেখা যায়। এ সময় কৈল্যার স্থানীয় বাজারের দুইটি শিশুকে ওই যুবক তার ব্যাগ থেকে চকলেট বা বিস্কুট দিতে চাইলে এলাকাবাসীর ছেলেধরা সন্দেহ হয়। পরে তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
সিংড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, আটক যুবক ছেলেধরা কি না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সিংড়ার সর্বত্রই এখন ছেলেধরা আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিষয়টি আসলে কীÑ প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, এ বিষয়ে সচেতনতামূলক পোস্ট দেয়া হয়েছে। আর এলাকায় কাউকে সন্দেহ হলে আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দিতে বলা হয়েছে। এবং প্রত্যেক বাবা ও মাকে তার ছেলেমেয়ে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হবে। তারা কোথায় যায় বা কী করে? মাদক থেকে শুরু করে বিপথগামী হয় কি না? তা ছাড়া এ বিষয়ে গ্রাম পুলিশদেরকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
ঝালকাঠি সংবাদদাতা জানান, ঝালকাঠিতে ছেলেধরা সন্দেহে হাসিব বাপ্পি (২৭) নামের এক যুবককে স্থানীয় লোকজন গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে। গতকাল সকালে সদর উপজেলার শেখের ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বাপ্পি বরিশাল শহরের রূপাতলী খান সড়ক এলাকার মো: সোহরাব হোসেনের ছেলে। পুলিশ জানিয়েছে, হাসিব বাপ্পি একজন পেশাদার চোর ও মাদকসেবী। তার বিরুদ্ধে বরিশালের কোতয়ালি থানায় ছয়টি চুরির মামলা রয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, হাসিব মির্জাপুর গ্রামের আলমগীর সিকদারের বাড়ির চার পাশে কিছু সময় সন্দেজনকভাবে ঘোরাঘুরি করে। পরে সে স্থানীয় পনির সরদারের ঘর থেকে একটি বঁটি ও একটি ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করে পালানোর চেষ্টা করে। তার হাতে বঁটি দেখে স্থানীয় লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই দিয়ে আটকে রাখেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাকে সোপর্দ করেন এলাকাবাসী। ঝালকাঠি থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। বরিশাল কোতয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে ছয়টি চুরির মামলা রয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে ছেলেধরা সন্দেহে এবার পাঁচ এনজিওকর্মীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন এলাকাবাসী। গতকাল দুপুরে জেলার চারঘাট উপজেলার রাওথা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
পাঁচ এনজিওকর্মী হলেনÑ ঢাকার লালবাগের অধিবাসী আব্দুল কাইয়ুম, গোপালগঞ্জের আবুল হোসেন, হাফিজুর রহমান, রেজাউল করিম ও আবুল কালাম। তারা আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার নামে একটি এনজিওর কর্মী বলে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। তবে এর স্বপক্ষে তারা কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম ও স্থানীয়রা জানান, ওই এনজিও কর্মীরা বাড়ি ভাড়া নেয়ার জন্য এলাকায় ঘুরছিলেন। এ সময় রাওথা গ্রামের বাসিন্দারা তাদের সন্দেহ করেন। একপর্যায়ে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন এলাকাবাসী। কিন্তু অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করলে এলাকাবাসীর সন্দেহ আরো প্রবল হয়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এরপর এলাকাবাসী ওই পাঁচ এনজিওকর্মীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন।
ওসি জানান, ওই এনজিও কর্মীদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। তারা যে এনজিওর পরিচয় দিয়েছেন তার কার্যালয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে তারা কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে জানান। ওসি বলেন, বর্তমানে তাদের থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, যথাসময়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে না গেলে বড় ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। তবে তাদের গণপিটুনি দেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। শুধু স্থানীয়দের সাথে তাদের সামান্য ধাক্কাধাকি হয়েছে।
হবিগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, হবিগঞ্জের অলিপুরে ছেলেধরা সন্দেহে তিনজনকে গণপিটুনি দেয়া হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলো মাধবপুর উপজেলার নোয়াপাড়া কাশিপুর গ্রামের তোরাব আলীর ছেলে মোখলেছ মিয়া (৩২), একই এলাকার রতনপুর গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে গিয়াস উদ্দিন (৩২) ও বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার হাতিপুর গ্রামের শাহেদ মোল্লার ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৩০)।
শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি আনিছুজ্জামান জানান, অলিপুর এলাকায় ওই তিন ব্যক্তি একটি সিএনজিতে করে ঘোরাফেরা করছিল। এ সময় তাদের ঘোরাফেরা দেখে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছেলেধরা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আর এতে স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া করলে তারা সিএনজি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় স্থানীয় জনসাধারণ তাদের আটক করে গণপিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
গণপিটুনির শিকার ওই তিন ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে দুলাল আহমেদ নামে এক কনস্টেবল আহত হয়েছেন। তাকেও হাসাপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: হায়দার আলী জানান, তিনজনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ছেলে ধরা সন্দেহে রেনু নিহত হওয়ার মামলায় ৩ জন রিমান্ডে
আদালত প্রতিবেদক জানান, ঢাকার উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেনু নিহত হওয়ার মামলায় গ্রেফতারকৃত তিন যুবককে চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বাড্ডা থানা পুলিশ তাদের ঢাকার মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডলের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায়। আদালত শুনানি শেষে এদের প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। যাদের রিমান্ড দেয়া হয়েছে তারা হলো- বাচ্চু, বাপ্পী ও শাহীন। জাফর নামে আরেক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
রিমান্ড প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে জাফর, বাপ্পী ও শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে বাচ্চুও গ্রেফতার হয়। ছেলেধরা সন্দেহে তসলিমা বেগম রেনুকে কেন তারা হত্যা করেছে এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
সাভার (ঢাকা)সংবাদদাতা জানান, সাভার পৌর এলাকার রাজাবাড়ী মহল্লায় ছেলে ধরা সন্দেহে স্বামী-স্ত্রীকে গতকাল সোমবার গণধোলাই দিয়েছে এলাকাবাসী। পরে পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তারা হলোÑ রনি মিয়া (২৩) ও তার স্ত্রী বিলকিস খাতুন (২০)। তারা রাজবাড়ি জেলার গোদাগাড়ী থানার সাহেববাজার গ্রামে বাসিন্দা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রনি মিয়া ও তার স্ত্রী সাভার পৌর এলাকার রাজাবাড়ি মহল্লার আমিনুল ইসলামের বাড়িতে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। গতকাল দুপুরে প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া রুমি আক্তার নামের এক তরুণীকে মুখ চেপে ধরলে ওই তরুণী ছেলে ধরা সন্দেহে ডাক-চিৎকার দিলে এলাকাবাসী একজোট হয়ে স্বামী-স্ত্রীকে গণধোলাই দেয়। পরে সাভার মডেল থানা পুলিশ খবর পেয়ে তাদেরকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
সাভার মডেল থানার এসআই নাজমুল হক বলেন, রনি মিয়া ও তার স্ত্রী প্রতিবেশী একটি মেয়ের সাথে প্রতারণা করছিল এবং বলছিল তোমার মায়ের স্বর্ণ-গহনা কোথায় জানতে চাইলে পাবলিক ছেলে ধরা সন্দেহে মারধর করে। তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় থানায় মামলা করা হবে।


আরো সংবাদ



premium cement