২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভাঙন আতঙ্কে বানভাসিরা

উজানের পানিতে বাড়ছে নদীভাঙন ; নদীভাঙনে গৃহহীন কয়েক হাজার পরিবার ; রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিচ্ছে লোকজন ; স্কুল, রাস্তা যাচ্ছে নদীতে
-

উজানের ঢলের কারণে কিছু কিছু জেলা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। পদ্মা, যমুনা, বাঙালি নদীর পানি এখনো বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন নদীভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে লোকজন, তেমনি বাঁধ-সড়ক ভাঙনের আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন। এ পর্যন্ত নদীভাঙনের কারণে কয়েক হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া স্কুল, বাজার, মসজিদসহ অনেক স্থাপনা যেকোনো সময় চলে যেতে পারে নদীতে। বিভিন্ন এলাকায় ধান, পাট ও সবজিক্ষেত পানিতে ডুবে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। সেই সাথে ত্রাণের অপ্রতুলতার কারণে ক্ষোভ বিরাজ করছে বন্যাদুর্গত এলাকার লোকজন।
এদিকে বন্যার কারণে পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীতে ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রী ও চালকরা। হাজার হাজার গাড়ি কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন কাঁচামালে পচন ধরায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
টাঙ্গাইল সংবাদদাতা জানান, গতকাল শনিবার দুপুরে টাঙ্গাই-ভূঞাপুর সড়কের শ্যামপুর ব্রিজের ডাইভারশন কেটে দিয়েছেন পানিবন্দী মানুষ। ফলে এ সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ভুক্তভোগীরা জানান, ঠিকাদারদের দুর্নীতি ও সড়ক কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই এ নি¤œমানের ডাইভারশন করা হয়েছে। আর বন্যায় ভোগান্তি পোহাচ্ছি আমরা। এছাড়া টাঙ্গাইলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক ভেঙে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছয়টি উপজেলায় ৩৪টি ইউনিয়নের ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত আড়াই লাখ মানুষ। এছাড়া এসব গ্রামের রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৮৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নদীভাঙনের ফলে সহস্রাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় অনেকে গরু-ছাগল ও পরিবার নিয়ে বিভিন্ন উঁচু রাস্তায় এবং আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে পানি নেমে আসায় মানিকগঞ্জের নদ-নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে জেলার ঘিওর, দৌলতপুর, শিবালয় ও হরিরামপুরÑ এ চারটি উপজেলার নদীর তীরবর্তী এলাকায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলের নিচু এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ছে ফসলের মাঠ। নদীভাঙনের কারণে শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের গোয়ারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আরুয়া ইউনিয়নের কুষ্টিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে। এ ছাড়া আরিচা বন্দর ও আরিচা-কাশাদহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের নিহালপুরের অংশ এবং আরিচা নদী বন্দর, শিবালয় বন্দর বাজারও হুমকির মুখে রয়েছে। মানিকগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: বাবুল মিয়া জানান, বন্যা এবং নদীভাঙন রোধে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ঘিওরে নদীভাঙনে বাঁধের নিচের অংশে ধস নেমেছে। এতে ঢাকা-ঘিওর-দৌলতপুর ভায়া টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়কটি (ঘিওর উত্তর পাড়) ও ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অতি দ্রুত ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে যেকোনো সময় বাঁধটি ধসে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি ভাঙনের কবলে পড়ে ধলেশ্বরী নদীর ওপর থাকা একমাত্র ব্রিজ, আশপাশের বাড়িঘর, স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও কবরস্থান নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে যাবে ঢাকা-ঘিওর-দৌলতপুর ভায়া টাঙ্গাইল আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কয়েক দিন ধরে রাতদিন বাঁধ পাহারা দিচ্ছে এলাকাবাসী। ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সরিয়ে নিচ্ছে অন্য স্থানে। এমতাবস্থায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে ঘিওর উত্তর পারের এলাকাবাসীর।
এদিকে আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানিকগঞ্জের পাঁচটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পানিপ্রবাহের মাত্রাও বাড়ছে। জেলার অভ্যন্তরীণ কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি নদীতে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। জেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব মতে, জেলার দৌলতপুর, শিবালয়, ঘিওর, হরিরামপুর ও সাটুরিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৪৩টি গ্রামে ২১ হাজার ৯১৮ পরিবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বন্যায় ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যার চলমান পরিস্থিতিতে মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছেই। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে। নেই শৌচকর্ম সারার কোনো ব্যবস্থা। এর অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। তরকারির অভাবে সাদা ভাত লবণ দিয়ে খাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই জেলার সাড়ে আট লাখ বানভাসি মানুষের। ২০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় এক হাজার ২৪৫ কিলোমিটার রাস্তা, ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৪১টি ব্রিজ ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৪টি। প্রায় দুই লক্ষাধিক গবাদিপশু পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চিলমারী উপজেলার ৩১ হাজার পরিবারের প্রায় সবাই পুরোপুরি পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানির তোড়ে অষ্টমীর চর ইউনিয়নের ৭৮টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। গতকাল শনিবার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে খামার বাঁশপাতারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রমনা রেলস্টেশনের উত্তরে রেললাইনের নিচ থেকে ১৫০ মিটার এলাকার মাটি পানির তোড়ে সরে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো: হাফিজুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত ৮০০ মেট্রিক টন জিআর চাল, ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তিন হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ছয় হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
শেরপুর সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে প্রবল বেগে নেমে আসা ঢলের কারণে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শেরপুর সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের ৪৫টি গ্রামের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার পরিবার। কাঁচা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি ক্ষেত ও শতাধিক পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। গবাদিপশু নিয়ে তারা চরম বিপাকে পড়েছে। বাড়িতে পানি ওঠায় চুলা জ্বালাতে পারছে না প্লাবিত এলাকার মানুষ। শেরপুর-জামালপুর সড়কের পোড়ার দোকান এলাকার কজওয়েটি ছয়-সাত ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় শুক্রবার থেকে শেরপুর-ঢাকা এবং উত্তরবঙ্গের সাথে এ পথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। অপর দিকে ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর পানি কমে যাওয়ায় ওই দুই উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় জেলার ৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। জেলায় ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল বলে জানিয়েছে বানভাসি মানুষ। জেলায় এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়নি। শেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পিকনকুমার সাহা জানান, উপজেলার ১৫ হাজার ১০০ কৃষকের রোপা আমন বীজতলা, আউশ ধানের ক্ষেত, সবজি ও পাটের আবাদকৃত এক হাজার ৩৩০ হেক্টর জমি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
বগুড়া অফিস জানায়, যমুনা নদীর পানি কমলেও বাঙালি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।
সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদী সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপড়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার চরাঞ্চলের ৯টি ইউনিয়নের ৩ হাজার হেক্টর জমির পাটসহ প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। তার মধ্যে সাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য দিকে, বাঙালি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনটি ইউনিয়নে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সোনাতলা সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীতে পানি কমায় উপজেলার বানভাসী মানুষের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এখনো সেখানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পাট, আউশ ধান, বীজতলা ও মরিচ ক্ষেতের ক্ষতি হওয়ায় ওই উপজেলার কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
শরীয়তপুর সংবাদদাতা জানান, উজানের বন্যার পানি নামতে শুরু করায় জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নড়িয়া-জাজিরা সড়কের পোড়াগাছা এলাকায় সড়কের অনেক স্থান পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সড়কের পাচুখারকান্দি এলাকায় একটি সেতুর নির্মাণকাজের জন্য তৈরি বিকল্প সড়কটি ভেঙে গেছে। ফলে ওই সড়কে গতকাল শুক্রবার থেকে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পদ্মার পানি বাড়ায় এ দুই উপজেলার অনেকগুলো স্কুলের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার বলেন, কয়েক দিনে পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে ১২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর তীরবর্তী কিছু নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।
রাজবাড়ী সংবাদদাতা জানান, তীব্র স্রোত, ফেরি সঙ্কট এবং পানিতে ঘাটের র্যাম তলিয়ে যাওয়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে নৌযানে যানবাহন পারাপারে অচলবস্থা কাটেনি। প্রচণ্ড স্রোতের বিপরীতে বেশির ভাগ ফেরিই স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে না। যে ফেরিগুলো চলাচল করছে সেগুলোতেও প্রতি ট্রিপে অনেক বেশি সময় লাগছে। উভয় ঘাটে নদী পারের অপেক্ষায় আটকে পড়ছে সহস্রাধিক যানবাহন। গতকাল শনিবার দৌলতদিয়া ঘাট থেকে গোয়ালন্দ পৌরসভা পর্যন্ত প্রায় পৌনে ৫ কিলোমিটারজুড়ে মহাসড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। যানজটে আটকে পড়ে যাত্রী ও চালকরা সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ২-৩ দিন ধরে আটকে থেকে কাঁচামালবাহী কয়েক শ’ ট্রাকের পণ্য পচতে শুরু করেছে।
এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ী গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া গেজ স্টেশন পয়েন্টে পদ্মার পানি ২৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে নদী তীরবর্তী নি¤œাঞ্চল ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে জেলার পাংশা, কালুখালী, সদর, গোয়ালন্দ উপজেলার বেশ কিছু স্থানে।
এ দিকে কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ও কালিকাপুর ইউনিয়নের প্রায় ১২ হাজার মানুষ তাদের গবাদিপশু নিয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সেখানকার বন্যাদুর্গতরা এ পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বা কোনো সাহায্য পায়নি। বিশুদ্ধ পানি ও স্যনিটেশনের সঙ্কটে তাদের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। হঠাৎ বন্যায় ধান ও পাট ফসল ডুবে যাচ্ছে। কৃষকেরা পাট কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক পাচ্ছে না।
মাদারীপুর সংবাদদাতা জানান, ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ২৭ সে.মি. বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌরুটের ফেরি চলাচল। মূল নদী থেকে লৌহজং টার্নিংয়ের প্রবেশমুখে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ ঘূর্ণাবর্ত। গতকাল শনিবার পানিতে তলিয়ে যায় কাঠালবাড়ির চারটি ঘাট। মাত্র ৪-৫টি ফেরি কোনোমতে চলছে। চলমান ফেরিগুলোও ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘসময় ব্যয় করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। এতে উভয় পাড়ে ১২ শ’ যানবাহন আটকে পড়ে আছে। এ অবস্থায় এ রুটে দক্ষিণাঞ্চলের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। উভয় ঘাটে দেড় কিলোমিটারজুড়ে ট্রাকের সারি দেখা গেছে। দীর্ঘ দিন ঘাটে আটকে থাকায় পেঁয়াজসহ বিভিন্ন কাঁচামালে পচন ধরেছে। বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ঘাট ম্যানেজার আব্দুস সালাম বলেন, পানি বাড়ার গতি খুবই অস্বাভাবিক। আমাদের ঘাটের চারটি ঘাটই তলিয়ে গেছে পানিতে। আমরা যানবাহনগুলোকে বিকল্প পথ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি।
বকশীগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, জামালপুরের বকশীগঞ্জে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। বানভাসি এলাকায় এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী না দেয়ায় মানুষের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। ত্রাণের বরাদ্দ কম হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
গত ৬ দিনে বন্যায় বকশীগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভাসহ সাতটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এর মধ্যে চারটি ইউনিয়নের শতভাগ এবং তিনটি ইউনিয়নের ৯০ ভাগ গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া পৌর এলাকার ৭০ ভাগ গ্রাম প্লাবিত হয়। ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে বকশীগঞ্জ উপজেলার দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ দিকে উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে ও সাপে কেটে এ পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছে এবং একজন নিখোঁজ হয়েছে। শুকনো খাবারের সঙ্কট থাকায় এসব গ্রামের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন। গত তিন ধরে তারা না খেয়ে দিন পার করছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে ৬০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। দুই হাজার জনকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। পাশাপাশি বন্যার কারণে নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থারও বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি ধীর গতিতে হ্রাস পেলেও করতোয়া নদীর পানি এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দী পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট, স্যানিটেশনের অব্যবস্থা, গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার সূত্রে জানা গেছে, ত্রিমোহিনী থেকে বোনারপাড়া স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত অব্যাহত থাকায় লালমনিরহাট-সান্তাহার রুটে গাইবান্ধার ত্রিমোহিনী রেল স্টেশন থেকে বোনারপাড়া জংশন পর্যন্ত গত বুধবার থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় এ পর্যন্ত জেলার সাতটি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নের ৩৮৩টি গ্রামের চার লাখ ৮৫ হাজার ৩৫০ লোক এবং ৪৪ হাজার ৭৯২টি বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ৫৭৫ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা এবং ২৩৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬৩ কিলোমিটার বাঁধ, ২১টি কালভার্ট এবং ১০ হাজার ৮৩৩ হেক্টর আবাদি জমি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ১৭৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২৬৪টি মাদরাসায় পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পুকুর-খামারগুলো ডুবে যাওয়ায় দুই হাজার ৯৪১টি পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
ফরিদপুর সংবাদদাতা জানান, গতকাল শনিবার সকালে পদ্মার গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। এতে আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এরই মধ্যে জেলার চারটি উপজেলার নি¤œাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ফরিদপুরের অর্ধশতাধিক গ্রাম এখন বন্যার পানিতে নিমজ্জিত।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত চার দিনে শুধু জেলা সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে দুই হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমির বোনা আমন ক্ষেত এবং এক হাজার ৯৮ হেক্টর জমির আউশ ধানের ক্ষেত বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সবজি ক্ষেত তলিয়েছে প্রায় ১২৪ হেক্টর। ফরিদপুরের সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের বন্যাকবলিতরা জানান, ‘বন্যার পানিতে জমির সব ফসল তলিয়ে গেছে। আউশ-আমন ধান কাটার সময় পাইনি’।
ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে বন্যার পানিতে পড়ে মারা গেছে দুই বছরের শিশু তাকিয়া আক্তার। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার লাশ বাড়ির সামনে উঠানে বন্যার পানিতে ভাসতে দেখা যায়। তাকিয়া উপজেলার চর হরিরামপুর ইউনিয়নের ছমির ব্যাপারিরডাঙ্গী গ্রামের কামালখানের মেয়ে। চর হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান আমির খাঁ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সবার অলক্ষ্যে বাড়ির উঠানে বন্যার পানি পড়ে মারা গেছে দুই বছরের মেয়ে তাকিয়া।

 


আরো সংবাদ



premium cement