২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিহত ৩

-

ছেলেধরা আতঙ্কে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গতকাল শনিবারও ঢাকায় ও নারায়ণগঞ্জে তিনজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে রাজধানীসহ সারা দেশে ছেলে ধরা সন্দেহে নারীসহ সাতজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এর আগে গত ৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে ও ১৮ জুলাই নেত্রকোনায় দুইজন নিহত হয়। এরমধ্যে নেত্রকোনায় গণপিটুনির শিকার ওই ব্যক্তির ব্যাগ থেকে একটি শিশুর মাথাও উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশ ও এলাকাবাসীর। এ ছাড়াও ১৭ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে গণপিটুনির শিকার হন তিনজন।
রাজধানীর বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহতের পরিচয় পাওয়া গেছে : মৃতের ভাগিনা সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু তাকে শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, তাসলিমা বেগম রেনু (৪০) মহাখালীর ৩৩/৩ জিপি জ ওয়ারলেস গেটে থাকতেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। এর আগে তিনি স্কুলের পাশে আলী মোড় এলাকায় স্বামী তসলিম হোসেনের সাথে পরিবার নিয়ে থাকতেন। গত দুই বছর পূর্বে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি সন্তানদের নিয়ে মহাখালীতে থাকতেন। তিনি বলেন, গতকাল সকালে উত্তর বাড্ডায় ওই স্কুলে গিয়েছিলেন সন্তানকে ভর্তি করার জন্য খোঁজখবর নিতে। আর সেখানে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, পুলিশ প্রশাসন থাকতে কিভাবে ওই এলাকার লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করল। আমি এর বিচার দাবি করি।
বাড্ডা থানার ওসি অপারেশন ইয়াসিন গাজী বলেন, প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করেন নিহত হওয়া নারীর ভাগিনাসহ স্বজনরা। গ্রামের বাড়ি রায়পুর লক্ষীপুর। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহটি ঢামেক মর্গে রাখা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, উত্তর বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা পাশাপাশি অবস্থিত। সেখানে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিন বোরকা পরিহিত নারী যান। তারা স্কুলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। বাধার মুখে দু’জন পালিয়ে গেলেও আরেকজন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান।
বাড্ডা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে এক নারী গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। পুলিশ গিয়ে ওই নারীকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ দিকে আমাদের ঢাকা জেলা সংবাদদাতা জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় ২ যুবককে গনপিটুনি দিয়েছে কেরানীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ এলাকার দুই গ্রামবাসী। এতে একজন নিহত হয়েছে অন্যজনকে গুরুতর আহতঅবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে কেরানীগঞ্জ উপজেলার হজরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এলাকাবাসী জানায়, শুক্রবার আনুমানিক ১০টার সময় অজ্ঞাত দুই যুবককে গ্রামের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখেন এবং গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। এতে তাদের উপর সন্দেহ হলে এলাকাবাসী তাদের ধরে মারধর করে। ঘটনাটি কেরানীগঞ্জের রসুলপুর এবং মানিকগঞ্জের চর পল্টন এলাকার সিমানায় হওয়ায় ওই এলাকার লোকজনসহ প্রায় ৪০০-৫০০ লোক সেখানে জড়ো হয়। পওে তাদের গণপিটনিতে ঘটনাস্থলে একজন মারা যায়। এ সময় কলাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আয়নাল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদেরকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনকে সেখানে ভর্তি করা হয় অন্যজনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। নিহত যুবকের লাশ এখনো হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। এ রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত তার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোবারক হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শুক্রবার রাতে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে কলাতিয়া ইউনিয়নের চেয়াম্যান আনোয়ার হোসেন আয়নালের নির্দেশে ভর্তি করা হয়। ভর্তির সময় ছেলেটি অচেতন ছিল। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। শনিবার দুপুরে তার জ্ঞান ফিরে আসে। ছেলেটি তার নাম আব্দুল আজিজ বলে জানায়। এ ছাড়া তার কাছ থেকে আর কোন তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই চুন্নু মিয়া বলেন, নিহত যুবকের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত যুবকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শাহালম বলেন, কয়েকদিন ধরে এলাকায় ছেলে ধরা আতঙ্ক বিরাজ করায় আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে সব গ্রামে মাইকিং করে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষে মাথা প্রয়োজন এ রকম গুজবকে যেন সাধারণ মানুষ বিশ্বাস না করে সে ব্যাপারে মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ গ্রামবাসী গুজবকে বিশ্বাস করে সন্দেহভাজন যুবকদের গণপিটুনি দিয়েছে।
আমাদের সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুই স্থানে ছেলে ধরা সন্দেহে দুইজনকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয় জনতা। এ ঘটনায় সিরাজ নামে এক যুবক (২৫) নিহত হয়েছে। অন্য দিকে, শারমিন (২০) নামে এক নারীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজির আলামিন নগর এলাকার রাজমিস্ত্রী সোহেলের সাত বছরের মেয়ে সাদিয়াকে অপহরণ করার সন্দেহে অজ্ঞাত এক যুবককে আটক করে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। পুলিশ গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনার দুই ঘণ্টা পর সকাল সোয়া ১০টার দিকে মিজমিজির শাপলা চত্বর এলাকায় ফাইজুল ইসলাম লাবিব নামে চার বছরের এক শিশুকে অপহরণ করার সন্দেহে শারমিন নামে এক নারীকে গণপিটুনি দেয়া স্থানীয়রা। পরে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ।
এ দিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছেলে ধরার বিষয়টি সম্পূর্ণই গুজব। সারা দেশে ছেলে ধরা গুজবের শিকার হয়েছেন ওই যুবক ও নারী। যুবককে গণপিটুনির ঘটনাস্থল থেকে ফিরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই শাখাওয়াত হোসেন জানান, যে বাচ্চা মেয়েটিকে নিহত ওই যুবক অপহরণ করতে চেয়েছিল তার অভিভাবক জানায়, তার মেয়ে স্কুলে ক্লাস করছে। মেয়েটি স্থানীয় আইডিয়াল কিন্ডারগার্ডেনের ছাত্রী। নিহত যুবক গুজবের শিকার বলে ধারণা হচ্ছে।
অন্য দিকে, ফাইজুল ইসলাম লাবিবের নানি খাদিজা আক্তার জানান, ছেলে ধরা সন্দেহে আটক নারী প্রথমে তার ফ্ল্যাটে ঢোকেন। পরে বিভিন্ন অসংলগ্ন কথা বলেন। সে এই ফ্ল্যাটে আগে ভাড়া ছিল বলে জানান। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে তারাই প্রথম ভাড়াটিয়া। পরে তাকে সন্দেহ হলে ভবনের নিচে যাওয়া হলে এলাকাবাসী তাকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে স্থানীয় একটি স্কুলের সামনে বেঁধে রাখেন। পরে পুলিশ খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিকেশন (পিবি আই) নারায়ণগঞ্জ জোনের পরিদর্শক (প্রশাসন) জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, শনিবার সকালে ঘটনার পরেই আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি। পিবিআইয়ের নারায়ণগঞ্জ জোনের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, আমি ও এসআই সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ টিপু সুলতানের নেতৃত্বে নিহতের ফিঙ্গার প্রিন্টসহ অনুষঙ্গ পরীক্ষা করে পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি। নিহতের নাম সিরাজ। তার বাড়ি সিদ্ধিরগঞ্জের ৫নং ওয়ার্ড এলাকাতে। সিরাজের বাবার নাম আবদুর রশিদ মণ্ডল ও মায়ের নাম কমলা খাতুন। আর গণপিটুনিতে গুরুতর আহত শারমিন কেরানীগঞ্জের সালমান মিয়ার স্ত্রী।
পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় ওই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে জনতা পুলিশ আধা ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ওই নারীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী আইডিয়াল ইসলামিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাঈদ রেদোয়ান আহমেদ জানান, তিনি সকালে তার ফার্মেসিতে বসা ছিলেন। এ সময় একটি মেয়ের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখতে পান তারই স্কুলের শিশু শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়াকে (৬) এক যুবক ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় আশপাশের লোকজন ছুটে আসলে ওই যুবকটি ইশারা ইঙ্গিতে মেয়েটিকে নিজের মেয়ে বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু স্কুলছাত্রীটিকে দেখে তিনি বলেন, এই মেয়েটি তার স্কুলের ছাত্রী সাদিয়া ও তার পিতার নাম সোহেল। ওই যুবকটি মেয়েটির পিতা নয়। তখন যুবকটি মেয়েটিকে নিয়ে পালানোর উদ্দেশ্যে দৌড় দেয়। সে তখন একটি রিকশায় ওঠার চেষ্টা করলে প্রথমে রিকশাচালক যুবকটিকে আটকে ফেলেন। এ সময় উত্তেজিত জনতা ছেলেধরা সন্দেহে ওই যুবকটিকে আটকে বেধড়ক পিটুনি দেয়। একপর্যায়ে তাকে গণপিটুনি দিলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে। পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে পাঠালে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) এইচ এম জসিম উদ্দিন জানান, নিহত ওই যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আহত ওই নারীকে চিকিৎসা শেষে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। ওই নারীর কথাবার্তায় তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মনে হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement