২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমেনি : টিআইবি

-

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যোগ্যতা নয়, ক্ষমতাসীনদের পছন্দ প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনের উপসচিব বা এর ওপরের পদে শূন্যপদের অতিরিক্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনও হয়। ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার : নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ তথ্য তুলে ধরে। গতকাল রোববার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।
টিআইবির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মহুয়া রউফ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলেন, রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে জাতীয় শুদ্ধাচারের কোনো কোনো কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তোষজনক। তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরুই হয়নি। গত নির্বাচনের আগে ৫৫ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ। ডিসি পদায়নে গোয়েন্দা রিপোর্ট একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব প্রতিবেদনে কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না, তা বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পদোন্নতি বিধিমালায় উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পদোন্নতিতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে অধিকতর প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কোন গোয়েন্দা সংস্থা কী বিষয়ে কখন কী প্রতিবেদন দিচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানার সুযোগ নেই।
সরকারি কর্মচারী আইনের কতিপয় মৌলিক ধারার সমালোচনা করে ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। এই আইনটির নাম হওয়ার কথা ছিল জনপ্রশাসন আইন। তাই আমরা আইনটির নাম সংশোধনের দাবি জানাই। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধিও সম্পূর্ণরূপে সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক। এই বিধিও বাতিল করতে হবে। এ ছাড়া এই আইনের ৬.১ ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্ত কর্তৃত্ব সরকারের কাছেই রাখা হয়েছে, যা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ এই সাংবিধানিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে যেগুলোতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিমূলক ইতিবাচক প্রণোদনা দেয়ার অঙ্গীকার ছিল, সে ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অভূতপূর্ব। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি এবং অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে বা দায়িত্ব পালনের ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা জবাবদিহিতা নিশ্চিতে যেসব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে সেগুলো শক্তিশালী করতে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে যেসব দিকনির্দেশনা বা কৌশল ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি বা কোনো ধরনের অগ্রগতি হয়নি। কাজেই আমরা একদিক থেকে যেমন সার্বিকভাবে অগ্রগতি হচ্ছে বিবেচনায় সন্তোষ প্রকাশ করতে পারি, অন্যদিকে বাস্তবে শুদ্ধাচার কৌশলের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া এখনো সুদূরপরাহত রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ এবং গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম।
গবেষণায় দেখা যায়, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ প্রণীত হওয়ার ছয় বছর পার হলেও এতে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে প্রণোদনা ও পারিতোষিক, প্রশিক্ষণ, যৌক্তিক বেতন কাঠামো, সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন, সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তনÑ এই পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তোষজনক। অন্যদিকে বার্ষিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নÑ এই তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরু হয়নি। আবার রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে কোনো কোনো কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না (যেমন প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি) এবং প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পেশাগত উৎকর্ষে ঘাটতির ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের ফলে জনপ্রশাসনে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ২০ শতাংশ পদ খালি থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টদের বিবেচনার জন্য ৯ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি ১৯৭৯ কে শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে হালনাগাদ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল কাঠামো করে সে অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে; সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি রাখার বিধান এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ধারা বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-তে ‘সরকারি’ শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করে আইনের সংশোধন করতে হবে। জনপ্রশাসনের ওপরের পদগুলোতে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিয়ে নিচের দিকের শূন্যপদগুলো পূরণ করতে হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ক্যাডারের সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে; প্রশাসন ক্যাডার হতে টেকনিক্যাল বিভাগের উচ্চপদে পদায়ন না করে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দিতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত স্কোর এবং দক্ষতার মূল্যায়ন-পূর্বক পদোন্নতি নিশ্চিতের বিধান রাখতে হবে; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ চূড়ান্ত করে তা কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ‘তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন ২০১১’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ আইন সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement