২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মোদির দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের মুসলিমদের পরিণতি কী হবে?

-

শনিবার পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে নবীন এমপিদের সামনে দেয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ভারতের মুসলিম সমাজকে এতকাল কাল্পনিক এক বাতাবরণ তৈরি করিয়ে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে আসা হয়েছেÑ যা এবার বন্ধ করার সময় এসেছে। মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিবিদরা কিন্তু বলছেন, এই ‘ভয়’ আদৌ অমূলক নয়, আর মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে চলছে তাতে আগামী পাঁচ বছরে অন্যরকম কিছু হবে বলে ভাবাও যাচ্ছে না।
সিওনিতে বিফ-হামলা, পার্লামেন্টে কাল্পনিক ভয় : ভারতে লোকসভার ভোটের ফল তখনো বেরোয়নি। ভোট গণনার আগের রাতে মধ্যপ্রদেশের সিওনি জেলায় বিফ বা গরুর গোশত বহন করা হচ্ছে, এই সন্দেহে জনতা একজন মহিলাসহ তিন ব্যক্তিকে আটকে বেদম মারধর করে যাদের নাম দিলীপ মালভিয়া, তৌফিক ও আনজুম শামা। খবর পেয়ে প্রথমেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্রেফতার করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আর গোশতের নমুনা পাঠানো হয় হায়দরাবাদে পরীক্ষার জন্য। এর দু’দিন বাদে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, মুসলিমদের এতকাল মিথ্যে ভয় দেখিয়ে আসা হয়েছে। তার কথায়, ‘এতদিন দেশের সংখ্যালঘুদের ভুল বুঝিয়ে আসা হয়েছে। ভালো হতো যদি তাদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করা হতো, যদি সমাজজীবনের বিভিন্ন স্তরে ওই সমাজ থেকে নেতারা উঠে আসতেন।’ কিন্তু তা না-করে ভোটব্যাংকের রাজনীতির জন্য তাদের সামনে একটা কাল্পনিক বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে দূরেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে, দাবিয়েও রাখা হয়েছে। শুধু ভোটে তাদের কাজে লাগানোর এই ছল এবার বন্ধ হবে, এটাই ২০১৯-এ এসে আমার কামনা।
হিন্দু রাষ্ট্রের জিগির : কিন্তু মোদির এই বক্তব্যে কতটা ভরসা করতে পারবেন ভারতের মুসলিমরা? কারণ এই প্রধানমন্ত্রীর আমলেই গত পাঁচ বছরে দেশের নানা প্রান্তে মুসলিমরা আক্রান্ত হয়েছেন আর তার দলের নির্বাচনী প্রচারেও বড় অংশ জুড়ে ছিল হিন্দুত্বের জিগির। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর কথায় কোনো আশার আলো দেখছেন না অ্যাক্টিভিস্ট ফারাহ নাকভি। মিস নাকভি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, দেখুন আগামীতে কী ঘটবে সেই পূর্বাভাস করতে পারব না তবে এটুকু বলতে পারি বিজেপির এবারের জয় আসলে হিন্দুত্বের ও হিন্দুরাষ্ট্রের চেতনার জয়, যা মৌলিকভাবেই সংখ্যালঘুবিরোধী। এই হিন্দুরাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ছাড়া কিছুই নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে যে কথা বলেছেন সেটা কি সংখ্যালঘু প্রশ্নে বিদেশী গণমাধ্যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য বললেন, না কি যে দক্ষিণপন্থী ক্যাডাররা গত পাঁচ বছর ধরে যে সহিংসতা আর গণপিটুনি চালাচ্ছে তাদের উদ্দেশে কোনো বার্তা দিতে চাইলেন?
প্রধানমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের যে ভয়কে অমূলক বলছেন, সেটাও একেবারেই মানতে রাজি নন ফারাহ নাকভি। ‘হামলার ঘটনাগুলো তো সত্যি সত্যি ঘটেছে, আমাদের অভিজ্ঞতায় সেটা আছে, কাজেই ভয়টা কেন কাল্পনিক হবে? বরং তারা তাদের কাজে প্রমাণ দিন যে সত্যিই মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
বিজেপি নেতারা সবাই ভোটের শেষ কয়েক সপ্তাহে লাগামছাড়া হিন্দুত্বের প্রচার করেছেন, সন্ত্রাসে অভিযুক্ত একজন হিন্দু সাধ্বীকে জিতিয়ে পার্লামেন্টে পাঠিয়েছেন।’
গান্ধীর হত্যাকারীকে দেশপ্রেমী বলে তারিফ করা সেই প্রজ্ঞা ঠাকুরকে বিজেপি সাসপেন্ড করে দেখাক, তবে না দেশের মুসলিম বা দলিতরা বুঝবে আগামী পাঁচ বছর তাদের জন্য একটু নিরাপদ হতে পারে!’, বলছিলেন মিস নকভি।
মোদিকেও মাটিতে ফেলতে পারে মানুষ : হায়দরাবাদের এমপি ও ভারতের মুসলিম সমাজের প্রথম সারির নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি আবার বিশ্বাস করেন, হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার আড়ালে লুকিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবার কিন্তু আর পার পাবেন না। ওয়াইসি বিবিসিকে বলছিলেন, গত টার্মের তুলনায় এবারে ফারাক একটাই হবে বলে আমার ধারণাÑ হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আর অকর্মণ্যতা বিজেপি আর ঢাকতে পারবে না।
কাজেই হিন্দুত্বর এজেন্ডা তাদের কিছুটা চাপা দিতেই হবে। নইলে যে হিন্দুস্তানের জনতা মোদিকে আকাশে তুলেছে, তারাই আবার একদিন জমিতে ফেলবেÑ ইন্দিরা গান্ধীর কথা নিশ্চয় সবারই মনে আছে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি তার দ্বিতীয় দফায় শেষ পর্যন্ত কোন রাস্তাটা বেছে নেবেন, সেটা শেষাবধি তার ওপরই নির্ভর করছে বলে মনে করেন মুসলিম দার্শনিক ও অধ্যাপক ড. মিরাতুন নাহার।
ড. নাহারের কথায়, ‘ভারতবর্ষের মতো একটা বহুজাতিক দেশে যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নিজের একটা নাম রেখে যেতে চান তাহলে যে নীতিগুলো তিনি এতদিন অনুসরণ করে এসেছেন তা এবার তাকে বিসর্জন দিতেই হবে।’ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না এ ব্যাপারে তার নিজের কোনও স্বাধীনতা আছেÑ আর স্বাধীনতা নেই বলেই বিজেপি-আরএসএসের অনুসৃত এই বিভাজনের রাজনীতিকে তিনি প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। নতুন মেয়াদেও স্বাধীনতাবিহীন অবস্থায় সেই একই নীতি তিনি জারি রাখবেন বলেই আমার আশঙ্কা’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিরাতুন নাহার।
অর্থাৎ যে ধর্মীয় বিচারধারার ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী সাফল্য এসেছে, দেশের শাসক হিসেবে তিনি তা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারবেন কি না এই সংশয় ভারতের মুসলিম সমাজের ভেতর কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement