২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

থেরেসা মের পদত্যাগ

ব্রেক্সিট কার্যকর না করতে পারার ব্যর্থতা
-

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল স্থানীয় সময় সকালে লন্ডনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সামনে এক আবেগপূর্ণ বিবৃতিতে মে বলেন, তিনি আগামী ৭ জুন পদত্যাগ করবেন। ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের ব্যাপারে তার নতুন পরিকল্পনা মন্ত্রিসভায় ও পার্লামেন্টে অনুমোদিত হবে নাÑ এটি স্পষ্ট হওয়ার পরই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। তবে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল পার্টি একজন নতুন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ নিয়েছেন। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
যুক্তরাজ্য ৪৬ বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য। দেশটি ইইউতে থাকবে নাকি বেরিয়ে আসবে তা নিয়ে ২০১৬ সালে সেখানে গণভোট হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরন। ওই গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ৫২ শতাংশ ও বিপক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এর পরই ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেছিলেন, কারণ গণভোটের সময় তিনি ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। ক্যামেরনের বিদায়ের পর ২০১৬ সালের জুলাই মাসে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হন। গণভোটের রায় ব্রেক্সিটের পক্ষে আসার পর ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগ করাটা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে দেশটির রাজনীতিকদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়।
থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সেটা কিভাবে হবে তার কোনো পরিকল্পনা তিনি দিতে পারেননি, যা পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভ করতে পারে। ব্রেক্সিট চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করানোর দু’টি চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় দফা ভোটের আগে থেরেসা মে ঘোষণা দিয়েছিলেন, চুক্তি পাস হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু এর পরও চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেন পার্লামেন্ট সদস্যরা। এরপর তার ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
গতকাল পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার সময় আবেগজড়িত কণ্ঠে থেরেসা মে বলেন, ‘২০১৬ সালের গণভোটের ফলের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুবই দুঃখজনক ঘটনা যে তিনি ব্রেক্সিট কার্যকর করতে পারেননি।’ বক্তব্য শেষ করার আগে মে বলেন, ‘আমি ব্রিটেনের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী কিন্তু আমিই শেষ নই। আমি যা করেছি তার পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। দেশের সেবা করার সুযোগ দেয়ায় আমি কৃতজ্ঞ।’
মে বলেন, ‘শিগগিরই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয়।’ যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে কাজ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সংক্ষিপ্ত বিবৃতির শেষ দিকে তার গলা ভেঙে আসে, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। যে দিন তিনি বিদায় নেবেন সে দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দুই বছর ৩২৭ দিন পূর্ণ হবে। মার্গারেট থ্যাচারের পর তিনি ব্রিটেনের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০১৭ সালে তিনি যে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেন, তাতে কনজারভেটিভ পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে ডিইউপির সমর্থন নিয়ে তাদের সরকার গঠন করতে হয়। এর পর থেকেই মে’র জনপ্রিয়তা ক্রমাগত কমতে থাকে। ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে তার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও একের পর এক পদত্যাগ করতে থাকেন।
ব্রেক্সিট কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে মে’র পরিকল্পনাটি ইইউ নেতাদের অনুমোদন পেলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ কমন্স সভায় এটি পরপর তিন বার উত্থাপন করেও তা পাস করাতে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর তিনি বিরোধী দল লেবার পার্টির সমর্থন নিয়ে পরিকল্পনাটি পাস করানোরও চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি যে সংশোধিত পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন সেটা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তার মন্ত্রিসভায় বা পার্লামেন্টে কোথাও এটি পাস করানো যাবে না। এর পরই দলের নেতারা মে’কে অবিলম্বে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন, দলের জনপ্রিয়তায় ধস ঠেকাতে ও ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের স্বার্থে থেরেসা মে’কে সরে যেতে হবে, যাতে নতুন কেউ নেতৃত্ব নিতে পারেন।
অবশেষে গতকাল শুক্রবার সকালে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন। মে বলেছেন, তিনি আশা করেন তার উত্তরসূরি যিনি হবেন তিনি ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কনজারভেটিভ পার্টি এখন নতুন একজন নেতা নির্বাচন করবে যিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্ভাব্যদের তালিকায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন, সাবেক ব্রেক্সিট মন্ত্রী ডমিনিক রাব, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট ও পরিবেশমন্ত্রী মাইকেল গোভের নাম রয়েছে।
থেরেসা মে গণভোটে ইইউতে থাকার পক্ষেই প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বলেন, ‘ইইউ থেকে বিচ্ছেদ মানে বিচ্ছেদ। যুক্তরাজ্য কোনোভাবেই ইইউর সদস্য থাকবে না এবং সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করেই যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্ধারণ করবে।’ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি এমন এক সরকার গড়ার অঙ্গীকার করেছিলেন যে সরকার শুধু কিছু সুবিধাভোগী নয়, বরং সব মানুষের জন্য কাজ করবে।
থেরেসা রাজনীতিতে আসার আগে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ফিন্যান্সিয়াল কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত লন্ডন বরো অব মর্টনে কাউন্সিলর হন। ১৯৯৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম লন্ডনের মেইডেনহেডের পক্ষে তিনিই প্রথম নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। ১৯৯৯ থকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের ছায়া কেবিনেটের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০২ সালে কনজারভেটিভ পার্টির প্রথম নারী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন থেরেসা মে। ২০১০ সালে তিনি ডেভিড ক্যামেরনের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত টানা ছয় বছর তিনি এ পদে ছিলেন।  


আরো সংবাদ



premium cement