২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঈদবাজারে ভারতীয় সাজ

আছে পাকিস্তান চীন থাইল্যান্ডের পণ্যও
-

ভারতীয় পোশাকে সেজেছে দেশের ঈদবাজার। ভিনদেশী পোশাকের এ আধিপত্য চোখে পড়ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে। সাধারণ কাপড়ের দোকানও এ প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আছে পাকিস্তানি, চীনা এবং থাইল্যান্ডের পোশাকেরও। ঈদ উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঝকমকে বিদেশী পোশাক দিয়ে দোকান সাজানো হয়েছে বলে জানান বিক্রেতারা।
গত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকার একাধিক বিপণিবিতান এবং শপিংমল ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ দোকানিই সাধ্যমতো বিদেশী পণ্যের সমাহার ঘটিয়েছেন। কিছু কিছু মার্কেট আছে যেখানে গর্বের সাথে বলা হচ্ছে, ‘দেশী পোশাক বিক্রি হয় না।’ আবার কোনো কোনো মার্কেট কমিটিই ঘোষণা দিয়েছে দেশী পোশাক বিক্রি করা হলে ওই দোকানির সদস্যপদ বাতিলসহ নানা শাস্তির কথা। আবার এমন অনেক শপিংমল ও বিপণিবিতান রয়েছে যেগুলোয় দেশী পণ্য বিক্রির কথা কল্পনাও করা যায় না।
সংশ্লিষ্টদের অনুমান, আসন্ন ঈদে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার পোশাকের বাজারে দেশী পোশাকের অবস্থান ২০ শতাংশেরও কম। ভারতীয় তন্তুজ, ভাগলপুরের সিল্ক, দিল্লি কটন, দিল্লির লেহেঙ্গা, সারারা লেহেঙ্গা, পার্টি শাড়ি, বোম্বে ডিজাইনের শাড়ি প্রভৃতিতে সয়লাব দেশের বাজার।
বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, পয়লা বৈশাখসহ দেশে বেশ কিছু মওসুম থাকলেও সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে। আকাশসংস্কৃতির সুবাদে সারা বিশ্বের ফ্যাশন জগৎ মানুষের সামনে চলে আসছে অনায়াসেই। এর মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতিই আমাদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলেছে। প্রতিনিয়ত ভারতীয় চ্যানেলে ডুবে থাকেন আমাদের দেশের মানুষ। তাই জাঁকজমক পোশাকের ক্ষেত্রে ভারতীয়টাই প্রথমে বেছে নেন তারা। গত বছরও ক্রেতাদের ঝোঁক ছিল বাহুবলি, দিল নাশি, বাজিরাও মাস্তানি, হুররম, করন-অর্জুন টু ও সেলফিসহ নানা ধরনের বাহারি নামের পোশাকের প্রতি। এবারো অবস্থা আগের মতোই। তবে এবার বিশেষ কোনো পোশাকের প্রতি আকর্ষণ নেই বলে জানান বিক্রেতারা।
বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউজগুলোর সংগঠন ফ্যাশন উদ্যোগের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে এবার ঈদকেন্দ্রিক বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। সেখানে দেশের বুটিক হাউজগুলোর ব্যবসা মাত্র চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকিটা বিদেশী কাপড় ও পোশাকের দখলে। ফ্যাশন উদ্যোগের হিসেবে বাজারে বিদেশী পোশাকের যে আধিপত্য তা ক্রেতাদের চাহিদার প্রেক্ষিতেই তৈরি হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্যাশন হাউজের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব দেশী ফ্যাশন হাউজ নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে পোশাক বানায় বলেই বিদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বলি হতে চান না। অবশ্য ভিন্নমত এসেছে ফ্যাশন-সংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকেই। তাদের দাবি, রাজেশ মালহোত্রা, মনিশ মালহোত্রা, সঙ্গীতা শিবরানী ও সত্য পালের মতো ডিজাইনারদের ডিজাইন করা শাড়ি, থ্রি-পিস, লেহেঙ্গা এখন ঢাকার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বসুন্ধরা সিটি, বনানী সুপার মার্কেট কিংবা পিংক সিটি, পলওয়েল মার্কেট, গাজী ভবনসহ অনেক মার্কেটের বহু দোকান এখন ভারতীয় ডিজাইনারদের ডিজাইন করা পোশাকে সয়লাব। বিদেশী শেরওয়ানি টাইপ পাঞ্জাবি ও কুর্তায় রয়েছে রাজকীয় ছোঁয়া। পাশাপাশি মনে রেখ, নীল আঁচল, মান্যবর থেকে শুরু করে বিভিন্ন দোকানেও ঢাকাইয়া জামদানি বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা জানান, ক্রেতাদের বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রতিই ক্রেতাদের আকর্ষণ বেশি। নিত্যনতুন ডিজাইন আর কাপড়ের মান উন্নত হওয়ায় চড়া দাম হলেও এসব পোশাকের প্রতিই মূল আগ্রহ ক্রেতাদের। আমাদের দেশে সে মানের ডিজাইনার গড়ে না ওঠাই বড় সমস্যা বলে জানান অভিজ্ঞরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরী পোশাক আমদানির ক্ষেত্রে বর্তমানে ৬২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য নিয়ে আসছে। আবার রফতানিকারকেরা সুতা ও বস্ত্র আমদানি করতে পারেন শুল্কমুক্ত উপায়ে। বন্ড সুবিধার আওতায় তারা শুল্কমুক্ত উপায়ে কাপড় আমদানি করে সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন খোলাবাজারে। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। দেশী বস্ত্রকলগুলো বসে যাচ্ছে, ফুলে-ফেঁপে বড়লোক হচ্ছে চোরাইপথে আমদানিকারকেরা।
এ দিকে বিদেশী পোশাকের আগ্রাসনে দেশী সুতা ও বস্ত্রকলগুলোর অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত ১৫ হাজার কোটি টাকার সুতা-কাপড় অবিক্রীত পড়ে আছে গুদামে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলার কারণে বাধ্য হয়ে এখন উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে সুতা-কাপড় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সাধারণত স্থানীয় বাজারের জন্য ঈদের আগের তিন মাসকে ভরা মওসুম হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এ ঈদের মওসুমেও বিদেশী অবৈধ সুতা-কাপড়ের দাপটে মার খাচ্ছে দেশীয় তাঁত ও বস্ত্রশিল্প।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে বলেন, শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহারের কারণে দেশে এক লাখের মতো তাঁতের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ এখন বন্ধ। রফতানিমুখী সুতা এবং কাপড় উৎপাদনের সাথে জড়িত মিলগুলোও চোরাইপথে আমদানি করা সুতার কারসাজিতে বিপদে পড়েছে। এসব কারণে উৎপাদনক্ষমতার ৬০ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট মিলগুলো। শুল্কমুক্ত আমদানির অপব্যবহারের কারণে এ বছর মিলগুলোর সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।


আরো সংবাদ



premium cement