২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সন্তানের পথ চেয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন মা আয়েশা

২০১৩ সালে গুম হওয়া মাসুমের ছবি হাতে মা-বাবা : নয়া দিগন্ত -

কারো কাছে কোনো কৈফিয়তই চাইবেন না মা আয়েশা। শুধু ছেলে আব্দুল কাদের ভুঁইয়া ওরফে মাসুমকে বুকে ফিরে পেতে চান তিনি। মাসুম ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই মা আয়েশার বুক হাহাকার করছে। ছেলে ফিরে আসবে এ আশায় এখনো নির্ঘুম রাত কাটান। ঈদ উৎসবে সন্তানের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকেন তিনি।
রাজধানীর তিতুমীর কলেজের ফাইন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন মাসুম। কোনো ধরনের রাজনীতির সাথে কখনোই জড়িত ছিলেন না তিনি। সব সময় বই নিয়েই থাকতেন। পড়াশোনাই ছিল তার ধ্যান আর জ্ঞান। সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতা আর সুঠাম দেহের অধিকারী মাসুম ছাত্রজীবন শেষ করে প্রতিরক্ষা বিভাগে বড় চাকরির স্বপ্ন দেখতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট হলেও মাসুমই পরিবারকে সচ্ছলতার স্বপ্ন বুননের গল্প শোনাতেন। ভবিষ্যৎ জীবনের নানা স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কথা শুনাতেন মাকে। মায়ের সাথে দুষ্টুমিতেও কম যেতেন না তিনি। কিন্তু ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই সোনার টুকরো ছেলেকেই খুঁজে ফিরছেন মা আয়েশা। ঘরের দরজা খুলে এখনো ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকছেন প্রতিনিয়ত।
ঢাকার তেজগাঁওয়ের পূর্ব নাখালপাড়ায় পরিবারের সাথে ভাড়া বাসায় থাকতেন মাসুম। নিজে মেধাবী ছাত্র হওয়ায় এবং সংসারের আয়ের জন্য বিকল্প হিসেবে নিয়মিত টিউশনিও করতেন তিনি। বাবা অসুস্থ। টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি বড় দুই ভাইকেও সব সময়ই সহায়তা করতেন মাসুম। ভালো চাকরির জন্য নিজেকেও প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু সব আয়োজনেরই হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে ২০১৩ সালে।
নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে মাসুমের মা আয়েশা জানান, ঘটনার দিন মাসুম বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যায় বসুন্ধরায় ঘুরতে গিয়েছিল। রাত ৮টার দিকে সেখান থেকেই নিখোঁজ হয় সে। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে ওর সঙ্গী বন্ধুদের কাছেই জানতে পেরেছি বসুন্ধরা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে কয়েক ব্যক্তি মাসুমকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু থানা পুলিশ র্যাব বা অন্য কেউই মাসুমকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি। পরের দিন মাসুমের বাবা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। (জিডি নং- ২৬৫, তাং ০৫/১২/২০১৩)।
মাসুমের মা আরো জানান, ১৬ ডিসেম্বর মাসুমের জন্মদিন। সব সময়েই এই দিনে ওর বন্ধুরা আমাদের বাসায় আসতো। আড্ডা জমাতো। বন্ধুরা মিলে হই হুল্লোড় করত। এখন আর কেউ আসে না। কিন্তু আমি এখনো ওই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকি। প্রতিটি ঈদেই আমি মাসুমের পোশাকগুলো গুছিয়ে রাখি। পড়ার টেবিল ও শোবার ঘরে মাসুমের স্মৃতি খুঁজে বেড়াই। অধির আগ্রহে থাকি- কখন বাবা আমার ফিরে আসে।
মাসুমের পরিবারের সদস্যরা জানান, মাসুম গুম হওয়ার পর প্রথম দিকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, আইন ও সালিস কেন্দ্র, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, আইনজীবী সংগঠনসহ অনেকেই সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন। আশা ছিল হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানেই মাসুমকে ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু সে আশায় আশায় ২০১৩ সাল থেকে আজ ২০১৯ সাল। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আমরা সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই অনুরোধ করব মাসুমকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন। কারো কাছেই আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা শুধু মাসুমকে ফিরে পেতে চাই।
মাসুম নিখোঁজ বা গুম হওয়ার পর দীর্ঘ এই ছয় বছরের মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে কী কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা জানতে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদক অনুসন্ধান করেছেন সংশ্লিষ্ট তেজগাঁও থানায়। বুধবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে তেজগাঁও থানায় গিয়ে প্রথমে ডিউটি অফিসার পুলিশের এএসআই আল আমীনের সাথে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় পুরনো এই জিডির বিষয়ে। তিনি জানান, পুরনো মামলা ও জিডির অগ্রগতি বা ফলাফলের বিষয়ে রেকর্ড রুমের সেরেস্তাদারই সব তথ্য দিতে পারবেন। পরে রেকর্ড রুমের সেরেস্তাদার এসআই মোশারফ হোসেনের সহায়তায় পুরনো ফাইল থেকে জানা গেল, মাসুম নিখোঁজের পর থানায় যে জিডি হয়েছিলে সেটি তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তৎকালীন এসআই রমজান আলীকে। থানার নথিতে তিনি নিখোঁজের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো ফলোআপ লিখে যাননি। রমজান আলীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন।


আরো সংবাদ



premium cement