২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

উদ্যম ও উচ্ছ্বাসহীন

সিপিডির মূল্যায়নে সরকারের ১০০ দিন
-

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে ‘উদ্যম, উৎসাহ ও উচ্ছ্বাসহীন’ বলে মূল্যায়ন করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলেছে, ‘শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো রকম দুর্নীতি আমরা সহ্য করব না; কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সেই দুর্নীতি প্রকটভাবে রয়েছে। খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলে, সরকার নতুন নতুন সার্কুলার দিয়ে ঋণখেলাপিদের সুযোগসুবিধা দিচ্ছে। জিডিপির যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা : বর্তমান সরকারের প্রথম একশ দিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির পক্ষ থেকে এ কথাগুলো বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে সংস্থাটির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
দেবপ্রিয় বলেন, শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছেÑ কোনো রকম দুর্নীতি আমরা সহ্য করব না; কিন্তু আমরা দেখছি রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে, অন্যান্য সামাজিক সেবার ক্ষেত্রে সেই দুর্নীতি প্রকটভাবে রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পরিবর্তনের, দিন বদলের। আর ওই বদলকে আটকে রাখছে এমন একটি গোষ্ঠী যারা এই দুর্নীতি থেকে সুবিধা ভোগ করছে। সুবিধাভোগী সম্প্রদায় যা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে আছে, সেটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের শক্তিকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। এর যদি সমাধান করা না যায়- তাহলে আওয়ামী লীগের সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুগঠিত ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবেই ইতিহাসে স্থান পাবে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, সরকারের বিগত ১০০ দিন আমরা একটি উৎসাহ, উদ্যোগ ও উচ্ছ্বাসহীন এবং একই সাথে উদ্যমহীন দেখেছি। অথচ আমরা আশা করেছিলাম একটি বড় ধরনের ১০০ দিনের উত্থান প্রতিফলিত হবে। এটা আমরা লক্ষ করিনি। আমরা লক্ষ করেছি গতানুগতিক ধারাবাহিকতা, নতুনভাবে সে রকম কিছু আমরা লক্ষ করিনি। বরং যে ধরনের উদ্যোগ আমরা দেখেছি, সে ধরনের উদ্যোগ মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। মিশ্র ইঙ্গিত কী দিচ্ছে? আমরা লক্ষ করেছি বিভিন্ন কর ছাড় দেয়া হচ্ছে। আমরা দেখেছি সুদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ফলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হবেÑ এটা আমরা মনে করি না। মনে হয় যেন কোথাও সরকারকে একটি প্রথিত গোষ্ঠী করায়ত্ত করে নীতিনির্ধারণ করছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সংশয় : জিডিপি প্রবৃদ্ধি গণনাপদ্ধতির সমালোচনা করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে দেখছি প্রবৃদ্ধিনির্ভর অর্থনৈতিক আলোচনা। এখানে কেমন একটা প্রবৃদ্ধি আচ্ছন্নতা বা আকৃষ্টতা দেখতে পাচ্ছি। অথচ অর্থনৈতিক তত্ত্বের সাম্প্রতিককালের চিন্তা দেখলে দেখা যাবে, সবাই বলবে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যথেষ্ট না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব করা আট দশমিক ১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ঈর্ষণীয় বলছে সিপিডি। তবে সিপিডি এই প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। সিপিডির মতে, এই হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। অর্থনীতির সূচকগুলোর সাথে এর মিল নেই। জিডিপির হিসাব আরো গভীরে গিয়ে করা উচিত। তা না হলে নীতিনির্ধারণে সমস্যা হবে।
সিপিডি কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরে জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সিপিডি বলেছে, উৎপাদন খাতনির্ভর এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলা হচ্ছে। বিবিএসের হিসাব মতে, চামড়া খাতে প্রথম প্রান্তিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু গতবার একই সময়ে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। সিপিডির মতে, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মানে হলো, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক যে প্রবৃদ্ধি দেখি তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু, প্রশংসনীয় এবং অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। তবে যেটুকু উন্নয়ন হয়েছে তাতে ব্যক্তি খাতের বাড়তি কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এই উন্নয়নের জন্য যে ধরনের কর আহরণ দরকার তা আমরা দেখলাম না। ব্যক্তি খাতে যে ধরনের ঋণপ্রবাহ বাড়ার কথা তা আমরা দেখলাম না। পুঁজিপণ্যের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। সেই সাথে ব্যাংক খাতে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে ধরনের চাঞ্চল্য থাকে তা-ও দেখলাম না। প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে ধরনের চলক থাকে, সে চলকগুলোর প্রতিফলন কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ছে না।
তিনি বলেন, জিডিপির গ্রোথ রেটে যে মূল্যসমন্বয়ক ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশের কিছু বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আমরা জানি মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ। ৫ শতাংশ রেখে কেন ৪ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি হারের সাথে সমন্বয়ে কোথায় সমস্যা সেটা জানার রয়েছে। এখানেও প্রবৃদ্ধির হার এক শতাংশ কমে যাওয়ার কথা। ফলে যেসব তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রবৃদ্ধি অনুমিত হয়েছে তা সম্পন্নভাবে প্রকাশ করা হোক।
সিপিডির বিশেষ এই ফেলো আরো বলেন, ‘যদি আমরা ধরি যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটা সঠিকভাবে অনুমিত হয়েছে। তাহলে বিনিয়োগ যেহেতু বেশি হয়নি, সুতরাং প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করতে হলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি দেখাতে হবে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে এমন কী প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনীর রূপান্তর ঘটল যে শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা এমন বৈপ্লবিকভাবে বেড়ে গেল! এটা আমাদের এখন ভালো করে চিন্তা করে দেখতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেসব দেশে বৈষম্য কম সেসব দেশে প্রবৃদ্ধি হার বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশে ঋণখেলাপি একটি বড় সমস্যা, এই সমস্যার কথা সবাই স্বীকার করছেন, সরকারও স্বীকার করছে। এটা কমিয়ে আনার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো এটা কমাতে গিয়ে নতুন নতুন সার্কুলার জারি করে ঋণখেলাপিদের সুযোগসুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে করে আমরা পেছনের দিকে চলে যাচ্ছি।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পুঁজিবাজারে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার ও উন্নতি নেই। নির্বাচনের আগে মুল্যসূচক কিছুটা বাড়লেও পরে ধীরে ধীরে তা আগের অবস্থানে চলে আসে। তিনি বলেন, বাজারে সূচকের যদি ওঠানামা দেখি তাহলে দেখা যায় প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ পয়েন্টের ভেতরে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত ওঠানামা হয়। পুঁজিবাজারে এভাবে ওঠানামা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে বিএসইসির যে ধরনের জোরালো ভূমিকা নেয়ার কথা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিএসইসি পদক্ষেপ নেয় বটে, তবে বাজারের কারসাজি বন্ধে দুষ্টচক্র থামানোর যে উদ্যোগ নেয়ার কথা, সে ক্ষেত্রে বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
শেয়ারবাজারের বর্তমান চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরপরই আমরা বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখলাম। এক মাস পর আবার সূচক আগের অবস্থানে চলে এলো। এখানে কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজারের উল্লম্ফন করা হয়েছিল কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় এবং বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিককালে মিডিয়ায় রিপোর্ট এসেছে। যেখানে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত ওঠা-নামানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। শেয়ারবাজারে এ ধরনের ওঠানামা হওয়ার কথা না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ওঠানামা হওয়ার কথা।
তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঋণখেলাপি। এটা কমছে না; বরং দিনদিন বাড়ছে। খেলাপি ঋণ উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না; বরং তাদের আরো সুযোগসুবিধা দেয়া হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement