২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
আলোচিত রাফি হত্যাকান্ড

আ’লীগ নেতা রুহুল আমিন রিমান্ডে

-

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় আটক হওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করেছে পিবিআই। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল শনিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্র্রেট সরাফউদ্দিন আহমেদ এ আদেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে রুহুল আমিনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক মো: শাহআলম সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সোনাগাজী পৌর শহরের নিজ বাড়ি থেকে রুহুল আমিনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রুহুল আমিন ওই মাদরাসার সদ্য বাতিল হওয়া পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই মামলার অন্যতম দুই আসামি মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম ও নুর উদ্দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এতে রুহুল আমিনের নাম উঠে আসে। শামীম জবানবন্দীতে জানায়, রাফির শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর দৌড়ে নিচে নেমে রুহুল আমিনকে ফোনে রাফিকে আগুন দেয়ার বিষয়টি জানায় সে। তখন রুহুল আমিন তাকে বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও।’
এদিকে ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষের কার্যালয়ে যৌন হয়রানির পর রাফির ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তৎপর ছিল রুহুল আমিন। তিনি এ সম্পর্কে থানায় মামলা কিংবা কাউকে না জানাতে রাফির পরিবারকে চাপ দেয়। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মামলা দেয়ায় এবং অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা গ্রেফতার হওয়ায় রাফির পরিবারের ওপর নাখোশ হন রুহুল আমিন। ৬ এপ্রিল রাফির মৃত্যুর পরও ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে রুহুল আমিন ও ওসি মোয়াজ্জেম নানা কূটকৌশল করে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। একপর্যায়ে ৮ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রত্যাহার করে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করার পর বেকায়দায় পড়ে যায় রুহুল আমিন। একে একে এজাহারভুক্ত আট আসামিসহ ঘটনায় অভিযুক্ত আরো সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। গত ক’দিন ধরেই রুহুল আমিনের গ্রেফতারের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাতে বিতর্কিত এ আওয়ামী লীগ নেতা অংশ না নেয়ায় তার গ্রেফতারের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেফতার করা না হলেও তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে ছিলেন।
রাফি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার : সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে আসামি জোবায়েরের ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার করেছে পিবিআই তদন্ত টিম। গতকাল শনিবার দুপুরে পৌর শহরের সরকারি কলেজসংলগ্ন ডাঙ্গি খাল থেকে উদ্ধার করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানায়, মামলায় গ্রেফতার জোবায়েরকে নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই-এর পরিদর্শক মো: শাহআলম বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান। জোবায়েরের দেয়া তথ্যানুযায়ী আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের বাড়ির অদূরে ডাঙ্গি খাল থেকে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার করা হয়। জোবায়েরের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ জানায়, রাফির গায়ে আগুন দেয়ার পরপরই বোরকাটি এখানে খুলে রেখে জোবায়ের পালিয়ে যায়।
কিলিং মিশনে অংশ নেয়া পাঁচজনের মধ্যে ছিল জোবায়ের। রাফিকে মেঝেতে শুইয়ে ফেলার পর জোবায়ের রাফির ওড়না দুই টুকরো করে তার হাত ও পা বেঁধে ফেলেন। জাবেদ তখন রাফির সারা শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয়। এরপর শাহাদাত হোসেন শামীমের চোখের ইশারায় জোবায়ের তার পকেট থেকে দেশলাই বের করে কাঠি জ্বালিয়ে রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর পাঁচজনই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। নামতে নামতেই তিনজন ছাত্র তাদের বোরকা খুলে শরীর কাপড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। ছাত্রী দু’জন মাদরাসায়ই তাদের পরীক্ষার কক্ষে চলে যান। আর বাকি তিনজন নিজেদের মতো করে পালিয়ে যায়। এরই মধ্যে আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম এ তথ্য জানায়। মামলার এজাহার নামীয় আটজনসহ ২০ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।
আর্থিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি : নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার ঘটনা তদন্তে আর্থিক লেনদেনের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে সিআইডি। গতকাল শনিবার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তদন্তের পর এ কথা জানান পুলিশ সদর দফতরের তদন্ত দলের সদস্য সিআইডির পুলিশ সুপার সম্রাট মোস্তফা কামাল।
গতকাল দুপুরে মাদরাসা চত্বরে গণমাধ্যমকর্মীদের সম্রাট মোস্তফা কামাল বলেন, রাফি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তারা কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছেন। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে সিআইডির একটি বিশেষ দল এসে মানিলন্ডারিং বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন। তিনি তার তদন্তের প্রতিবেদন সাত দিনের মধ্যে পুলিশ সদর দফতর ও পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে জমা দেবেন।
সিআইডির পুলিশ সুপার সম্রাট মোস্তফা কামাল সকাল থেকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করেন। এ সময় তিনি মাদরাসার অধ্যক্ষের দফতরের সহকারী নুরুল আমিন, নৈশপ্রহরী মো: মোস্তফা, আয়া বেবি রানী দাসসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেন।
নুসরাত হত্যার পরিকল্পনাকারীদের একজন রানা গ্রেফতার
ইফতেখার উদ্দিন রানা নামের এক যুবক নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের একজন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আরো একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। গ্রেফতার ইফতেখার উদ্দিন রানা (২১) ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের একজন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মঈনউদ্দিন জানান, গতকাল ভোরে রাঙামাটি সদরের টিঅ্যান্ডটি আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে রানাকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলানিউজ। সোনাগাজীর চরগনেশ এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে রানা ওই হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে রাঙামাটি চলে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
পিবিআই কর্মকর্তা মঈনউদ্দিন বলেন, নুসরাত পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তাই ভাই যে মামলা করেছেন সেখানে ইফতেখার উদ্দিন রানার নাম নেই। তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে আসে।
নুসরাতের পরিবারের সাথে শিবিরের সভাপতির সাক্ষাৎ : অগ্নিসন্ত্রাসে মৃত্যুবরণকারী ফেনী জেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির শোকাহত পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন। এ সময় তার সাথে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সাক্ষাৎকালে শিবির সভাপতি নিহত নুসরাত জাহান রাফির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি বলেন, বাবা-মায়ের মতো শিক্ষকও একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক। সহপাঠীরা আস্থার স্থান। কিন্তু রাফির প্রতি শিক্ষক ও সহপাঠীদের এমন নির্মমতায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। এ বর্বরতার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনো না ঘটে। কোনো বাবা-মা প্রিয় সন্তানের শ্লীলতাহানির ঘটনা শুনতে বা পোড়াদেহ দেখতে প্রস্তুত নয়। আমরা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাফি হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। সাথে সাথে সারা দেশে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও জানমাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
শিবির সভাপতি শোকাহত পরিবারকে আশ্বস্ত করে বলেন, ছাত্রশিবির নুসরাতের পরিবারের পাশে থাকবে। আমরা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেনো আমাদের মজলুম বোন নুসরাত জাহান রাফিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।


আরো সংবাদ



premium cement