২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ

২৯ বছর পর যাত্রা শুরু নতুন নেতৃত্বের

এ প্রয়াস গণতন্ত্রের একটি শুভ সূচনা, বললেন ভিসি; প্রধানমন্ত্রীকে আজীবন সদস্যপদ প্রদানে দ্বিমত ভিপি নূরের
নবনির্বাচিত ঢাকসু নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান : নয়া দিগন্ত -

১৯৯০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরে কেটে গেছে প্রায় ২৯ বছর। বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউনিয়নগুলোর নির্বাচন হলেও বাদ ছিল দেশের দ্বিতীয় সংসদ খ্যাত ডাকসু নির্বাচন। ভিসি আসেন ভিসি যান, থাকে নির্বাচনের আশ^াস, তবে পরিণতিতে তা আর বাস্তবতার মুখ দেখত না। কয়েকজন ভিসির সময়ে ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলেও বিভিন্ন মহলের কারণে তা আর হয়নি। দীর্ঘদিনের এ অচলায়তন ভেঙে সম্প্রতি উচ্চ আদালতের এক নির্দেশে গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। ছাত্রলীগ ছাড়া বিরোধী সব ছাত্র সংগঠনের প্রশ্নবিদ্ধ এ নির্বাচন বাতিলের দাবির মধ্যেই গতকাল দায়িত্ব গ্রহণ করেন নতুন নেতৃত্ব। দায়িত্বগ্রহণ করে গতকাল অভিষেক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে সচেতন থাকার আশ^াস পোষণ করেন তারা। এ প্রয়াসকে গণতন্ত্রের একটি শুভ সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান।
জানা যায়, ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন। এরপর সাড়ে ২৮ বছরে সাত বার ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও নানা জটিলতায় তা হয়নি। ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও সহিংসতার ফলে তা ভেস্তে যায়। এর পরে ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ তফসিল ঘোষণা করলেও ছাত্রলীগের বাধায় নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালে তফসিল ঘোষণা করা হলে সেবারও নির্বাচন হয়নি। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানান। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণায় ব্যর্থ হন তিনিও। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুন হলে ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৮ সালের ২৩ মে রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে মেয়াদোত্তীর্ণ ডাকসু ভেঙে দেয়া এবং পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৭ মে সিন্ডিকেট সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়। এরপরও অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী দুইবার নির্বাচনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তাও আলোর মুখ দেখেনি। ২০০৫ সালের মে মাসে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দিলে তাও আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০০৯ সালে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভিসির দায়িত্ব গ্রহণ করলে ডাকসু নির্বাচনের জোর দাবি ওঠে। তার আমলে ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ছাত্রপ্রতিনিধি ছাড়া ভিসি প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তারপর থেকেই ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে টানা আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। পরে ২০১৭ সালের শেষ দিকে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান। দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেন।
সর্বশেষ চলতি মাসের ১১ তারিখে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোট ব্যবস্থার নানান প্রকাশ্য অসঙ্গতির কারণে এ নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, বিক্ষোভসহ নানান কর্মসূচি পালন করে আসছে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে শিক্ষার্থীদের বিতর্কিত নির্বাচন বাতিলের দাবির মুখেই গতকাল প্রথম কার্যকরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতেই দায়িত্বগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা থাকলেও শুক্রবার দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর এবং সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। এ সময় নূর বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা বলতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে দায়িত্ব নিচ্ছি।
নির্বাচন বাতিলের দাবির মধ্যেই দায়িত্ব গ্রহণ নতুন নেতৃত্বের : ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন সর্বসাকুল্যে সুষ্ঠু হয়নি বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষকের প্রতিনিধিদল। ফলাফল ঘোষণা করতে দীর্ঘ সময় নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে নির্বাচন সম্পর্কে ভিপি নূর প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে ছাত্রলীগের একজনও পাস করত না। এ দিকে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করে পুনঃতফসিল ঘোষণা করে ফের নির্বাচনের দাবি তোলে ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি সবাই। এ দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, বিক্ষোভ, অনশন পালন করেন প্রার্থী-সমর্থকেরা। গতকালও বিতর্কিত এ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মৌন মিছিল করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এমন বিরোধিতার মুখেই গতকাল দায়িত্ব গ্রহণ করে নতুন কমিটি।
এ দিকে, প্রায় তিন দশক পর নির্বাচনের পর গতকাল ডাকসু ভবনের হল রুমে ডাকসুর বর্তমান সেশনের প্রথম সভা বেলা ১১টায় ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। নতুন ডাকসুর প্রথম কার্যকরী সংসদের বৈঠকে অংশ নিতে যথাসময়ে ডাকসু ভবনে উপস্থিত হন ভিপি নূর। তার সাথে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে নির্বাচিত হওয়া সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেনও ছিলেন। বাকি সবাই ছাত্রলীগের সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ মনোনীত।
প্রধানমন্ত্রীকে আজীবন সদস্যপদ প্রদানে দ্বিমত ভিপি নূরের : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডাকসুর আজীবন সদস্য করার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নূর। তার সাথে একমত পোষণ করেন সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেনও। প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডাকসুর আজীবন সদস্য করার দাবি জানান জিএস ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। এই দাবির বিরোধিতা করেন ভিপি নুরুল হক নূর। তিনি বলেন, যেহেতু এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা নির্বাচন বর্জন করেছেন, সেহেতু এ রকম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীকে সদস্য করার জন্য আপত্তি জানাই। সভায় পুনরায় ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে নূর বলেন, যদি পুনরায় নির্বাচন হয় এবং সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে আজীবন সদস্য করার ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়া যাবে।
শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় : ডাকসুর সভায় শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ডাকসুর নতুন পর্ষদ। সভায় গেস্টরুম ও গণরুম বন্ধ করার ব্যাপারেও কথা বলেন ভিপি নূর। এ ছাড়া একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় হলে উঠার বিরোধিতাও করেন তিনি। তবে এসব ব্যাপারে কথা বলেনি ছাত্রলীগ। সভায় ক্যাম্পাসে রিকশা ও সাইকেলের জন্য আলাদা লেন করার দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া নির্দিষ্ট রিকশাভাড়ার ব্যবস্থা করা ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও আলোচনা হয়। এসব ব্যাপারে উপস্থিত সবাই একমত প্রকাশ করেন।
গণতন্ত্রের একটি শুভ সূচনা : কর্যকরী সভা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান বলেন, এই কার্যকরী সভায় প্রতিনিধিদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি গণতন্ত্রের একটি শুভ সূচনা। প্রধানমন্ত্রীকে ডাকসুর আজীবন সদস্য করার প্রস্তাবের ব্যাপারে ভিসি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে আজীবন সদস্য করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। তবে পরের কার্যকরী সভায় আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। এ দিকে ডাকসুর পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল করেছেন। এ ব্যাপারে ঢাবি ভিসি বলেন, এটাও গণতান্ত্রিক একটি চর্চা। সবাই স্বাধীনভাবে মতামত জানাবে এটাই স্বাভাবিক।
ডাকসুর বর্ণাঢ্য অভিষেকে থাকবেন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী : ডাকসু ও হল সংসদের অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে বর্ণাঢ্য অভিষেক হতে যাচ্ছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অতিথি করা হবে ডাকসুর কার্যকরী পরিষদের এক সভায় গতকাল এ সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বড় আকারের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। সেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রিত অতিথি থাকবেন। একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান আয়োজন করার দায়িত্ব দিয়েছি কার্যকরী পরিষদকে। ভিপি, জিএস, এজিএসকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা বিভিন্ন কমিটি করে আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
এ দিকে ডাকসুর প্রথম সভা শেষে নবনির্বাচিত ডাকসু নেতারা ধানমন্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ভিসি চত্বরে অবস্থিত স্মৃতিচিরন্তনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement