২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঋণে কস্ট অব ফান্ডের অধিক সুদহার ধার্য করা যাবে না খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের খসড়া নীতিমালা

-

বড় ঋণখেলাপিদের ডজনখানেক সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নীতিমালা অনুমোদন পেলে ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক তার তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের (কস্ট অব ফান্ড) অধিক ঋণের সুদহার ধার্য করতে পারবে না। মূলঋণ, সুদহার ও সার্ভিস চার্জ আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে হবে। ডাউন পেমেন্টে ঋণ স্থিতির ১ শতাংশ অথবা এক কোটি টাকার মধ্যে যেটি কম সেটি জমা করেই খেলাপি ঋণ নবায়ন করা যাবে। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে দুই বছরের মরিটরিয়ামসহ মোট ১৫ বছর সময় দেয়া হবে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের নেতৃত্বে গঠিত আট সদস্যের একটি কমিটির প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনের আগে ঋণ পুনর্গঠনের খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে ব্যাংকগুলোর পরিপালনের জন্য নীতিমালা জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে ১১টি বড় শিল্প গ্রুপকে ঋণ পুনর্গঠনের নামে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছিল। মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিনিময়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছিল। যেখানে কোনো খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে প্রথমে মোট খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ এককালীন ক্যাশ (ডাউন পেমেন্ট) জমা দিতে হয়। ওই সময় শর্ত ছিল যারা ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নেবে তারা আর ওই ঋণ নবায়ন করতে পারবে না। কিন্তু ১১টি শিল্প গ্রুপ কেউই যথাসময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন ওই ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ উচ্চ আদালত থেকে ওই সব খেলাপি ঋণের স্থগিতাদেশ নিয়ে নতুন করে ঋণ নিচ্ছেন। নতুন ঋণ পুনর্গঠনের খসড়া নীতিমালায় ওই ১১টি শিল্প গ্রুপের ঋণও আবার নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তবে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইচ্ছা হচ্ছে না বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন পুনর্গঠনের খসড়া প্রতিবেদনে ঋণ পরিশোধের সময়কাল ১৫ বছর পর্যন্ত রাখার পক্ষে সরকার গঠিত উচ্চপর্যায়ের এ কমিটি। কমিটি বলেছে, এই ১৫ বছরের মধ্যে আবার দুই বছর মরিটরিয়াম থাকবে। অর্থাৎ এ দুই বছর ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এটি করা হলে ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটসহ মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অতিরিক্ত বর্ধিত মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া হলে বিশেষ করে নিয়মিত ঋণগ্রহীতাদের শুধু দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুবিধা গ্রহণের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণগ্রহীতায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ঋণ আমানত ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি সৃষ্টি হতে পারে এবং ব্যাংক তারল্য সঙ্কটে পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক মরিটরিয়ামসহ চলতি মূলধন ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ছয় বছর এবং মেয়াদি ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর করার পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরামর্শ আমলে নিচ্ছে না ওই কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সুদহার নির্ধারণের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো মূল ঋণের সাথে অর্জিত সুদ ও সার্ভিস চার্জ যুক্ত করা যাবে না। আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। পরিশোধের ক্ষেত্রে তিন অংশ থেকেই পরিশোধ করতে হবে। তবে কোনো গ্রাহক ঋণখেলাপি হলে সুদের ওপর সুদ ধার্য হবে না অর্থাৎ মূল ঋণ যে টুকু অবশিষ্ট থাকবে কেবল ওই পরিমাণ ঋণের ওপরই সুদ ধার্য হবে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। ঋণ পরিশোধের তেমন তাগিদ থাকবে না। অন্য দিকে সুদ ও অন্যান্য আয় কমে যাবে, যাতে বছর শেষে প্রভাব পড়বে ব্যাংকের সার্বিক মুনাফায়।
তবে বড় ঋণখেলাপিদের এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন ব্যাংক ও আর্থিক খাত বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, নামমাত্র শর্ত দিয়ে আর কী লাভ। জনগণের টাকা ঋণখেলাপিদের এমনিতেই দিয়ে দিতে পারে। তারা মনে করেন, এটি উদ্দেশ্যমূলক। ঋণখেলাপিদের বাঁচাতে যারা একের পর এক বিস্তর ছাড় দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছেন, তাদের সঙ্গে খেলাপিদের যোগসাজশের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হবে। বিতর্কিত এ নীতিমালা অর্থ মন্ত্রণালয় পাস করলে ব্যাংকিং সেক্টর আরো বিপদের মধ্যে পড়বে। তখন আর কেউ ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে চাইবে না। শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তারা খেলাপি না হয়ে এত দিন যে নিয়মিতভাবে ১২-১৩ শতাংশ সুদ দিয়ে এসেছেন সেটার হিসাব তাহলে কী হবে। তারা কী সুবিধা পাবেন। এখন খেলাপিদের জন্য ৭ শতাংশ সুদ হিসাব করলে তাহলে তাদের কাছ থেকে নেয়া অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ফেরত অথবা সমন্বয় করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement