১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নবাব কাটরা থেকে চুড়িহাট্টা

-

২০১০ সালের ৩ জুন রাত পৌনে ৮টা। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আবার কাজ শেষে কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, কেউ চা পান করছিলেনÑ সব মিলিয়ে পুরান ঢাকার নবাব কাটরার গলিটি তখন ছিল বেশ কোলাহলময়। আবার কেউ কেউ কাজ শেষে ঘরে ফিরছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। বুঝে ওঠার আগেই জ্বলতে শুরু করে বাড়িঘর, দোকানপাট। মানুষ দৌড়ে পালাচ্ছিল; আর আগুন যেন তাদের পেছনে ধাওয়া করছিল। অনেকে শরীরে আগুন নিয়েই ছুটে চলেন। একে একে লাশ হয়ে যান অনেকে। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায় একটি জনপদ। ঠিক তেমনটিই ঘটেছে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কোলাহলময় একটি জনপদ। পুড়ে গেছে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মানুষের আবাসস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয়সহ নানা স্থাপনা। পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে মানুষ। প্রত্যক্ষদর্র্শীরা বলেছেন, চুড়িহাট্টার ঘটনা মানুষকে সেই বিভীষিকাময় নবাব কাটরার ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিলো। মাঝে এভাবে ছোটখাটো আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটলেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি ক্যামিকেল গোডাউন, কারখানাসহ দাহ্য পদার্থের মজুদ। বিভিন্ন সংগঠনের একের পর এক কর্মসূচির পরেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তাদের ও অসাধু ব্যবসায়ীদের।
নবাব কাটরার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৫ জন মানুষ। দগ্ধ হয়ে এখনো সেখানে অনেক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ধনসম্পদ হারিয়ে অনেক মানুষ পথের ভিখারি হয়েছেন। মাসুম নামের এক ব্যক্তি জানান, নবাব কাটরার ঘটনার শিকার তারা। পোড়া শরীর নিয়ে এখনো বেঁচে আছে অনেকে। শারীরিক অক্ষমতার জন্য অনেকে কাজ করতে পারেন না। খুবই কষ্টে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় তাদের জীবন কাটছে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বলেন, নবাব কাটরার ঘটনার পর সোচ্চার হয়েছিল দেশের বিভিন্ন সংগঠন। তারা ওই সময় দাবি করেছিল পুরান ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন, দাহ্য পদার্থের মজুদ ও যেসব কারখানায় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার হয় সেসব কারখানা অন্যত্র সরাতে হবে। বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারাও একমত হয়েছিল ওই সব কারখানা, গোডাউন ব্যস্ততম এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত। চকবাজারের ব্যবসায়ী আবু কাউছার নয়া দিগন্তকে বলেন, ওই সব কারখানার কোনোটিই অন্যত্র স্থানান্তর হয়নি। বরং কোনো কোনা এলাকায় ২০১০ সালের চেয়ে কারখানা বেড়েছে। দাহ্য পদার্থের মজুদও বেড়েছে। কাউছার বলেন, প্রথম দিকে সরকারি সংস্থাগুলো একটু সোচ্চার ছিল; কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
নবাব কাটরার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। ২০১০ সালের ১৫ জুন ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে পুরান ঢাকার ক্যামিকেল কারখানা ও গোডাউন সরিয়ে ফেলাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। ওই সব সুপারিশের কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। বরং পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানার সংখ্যা আরো বেড়েছে। অলিগলিতে এখন কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন। একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরান ঢাকায় ২৫ হাজারের মতো কেমিক্যাল কারখানা ও গোডাউন রয়েছে; কিন্তু সরকারি হিসাবে তা আড়াই হাজারের মতো বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরান ঢাকার একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা কোনো দিন পুরান ঢাকা থেকে সরবে না। যারা এই উচ্ছেদ করবেন তাদের সাথে ওই কারখানা ও গোডাউন মালিকদের ভালো সম্পর্ক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর্থিক লেনেদেন রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। যে কারণে এত সংস্থা থাকার পরেও তারা ব্যস্ততম পুরান ঢাকায় নির্বিঘেœ কেমিক্যাল ব্যবসা করে যেতে পারছেন।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পরও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এ দিকে, দায়িত্বশীল সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা গতকাল চুড়িহাট্টার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। মন্ত্রী-এমপিরাও সেখানে গেছেন। তারা সবাই পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও কারখানা স্থানান্তরের কথা বলেছেন। তবে অনেকে তাদের সামনেই প্রশ্ন করেছেন, এটা কি হবে? এটা কি সম্ভব? তাহলে নবাব কাটরা ট্র্যাজেডির পর তা হয়নি কেন? এর মধ্যে তো ছোটখাটো আরো শ’খানেক ঘটনা ঘটেছে!
গতকাল বিকেলে এ রিপোর্ট লেখার সময় চুড়িহাট্টার ঘটনায় ৮১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, ‘এ জাতীয় ঘটনাকে আমি হত্যাকাণ্ড বলব। এ জাতীয় অপমৃত্যু বা অবহেলাজনিত মৃত্যু যেন আমাদের দেখতে না হয়। এ জন্য রাষ্ট্রের কাউকে-না-কাউকে দায় নিতে হবে।’ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে আরো অনেকেরই রয়েছে করুন কাহিনী। অসুস্থ মায়ের ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন নাফিস। মায়ের জন্য ওষুধ নিয়ে আর ফেরা হয়নি নাফিজের। অন্তঃসত্ত্বা রিয়াকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন স্বামী রিফাত। চার বছরের শিশুকে নিয়ে বাঁচাও, বাঁচাও আর্তনাদ করেও জীবন রক্ষা করতে পারেননি মা অনিকা তাবাসসুম নেহা। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফুয়াদের লাশ পেতে মায়ের মিনতি, কালি হোক, একটু যদি মাংস থাকে, মাংসের ফোঁটাও থাকে। আমার বাবারে এনে দেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement