২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভারতের সামরিক ব্যবস্থার পাল্টা হুমকি ইমরানের

-

ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামায় নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলার জন্য নয়াদিল্লি পাকিস্তানকে দায়ী করার পর গতকাল মঙ্গলবার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ভারত যদি সামরিক হামলা চালায় তাহলে পাল্টা জবাব দেবে পাকিস্তান। এ ক্ষেত্রে ভারতকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। এ দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গতকাল কাশ্মিরের মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে কেউ অস্ত্র হাতে নিলেই সাথে সাথে গুলি করা হবে। আরেক খবরে বলা হয়েছে, উগ্র হিন্দুদের হামলার আশঙ্কায় অধিকৃত কাশ্মিরের হাজার হাজার মুসলমান বিভিন্ন মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। খবর ডন নিউজ, দ্য নিউজ, এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের পুলওয়ামায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারির হামলার পর এ বিষয়ে গতকালই প্রথম মুখ খুললেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ওই হামলায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফের কমপক্ষে ৪০ সদস্য নিহত হন। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানভিত্তিক সংগঠন জৈশ ই-মোহাম্মদ। আর ভারত এ হামলার জন্য দায়ী করছে পাকিস্তানকে। তবে এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইমরান খান গতকাল দুপুরে দেয়া ওই ভিডিও বার্তায় বলেছেন, পুলওয়ামায় হামলার ঘটনায় ভারত যদি কোনো উপযুক্ত বা সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারে তাহলে পাকিস্তান অবশ্যই সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসতেও প্রস্তুত রয়েছে ইসলামাবাদ। কিন্তু ভারত যদি শুভবুদ্ধির পরিচয় না দিয়ে উসকানিমূলক পথে পা বাড়ায় তাহলে পাকিস্তান তার যথোপযুক্ত জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
ইমরান খান বলেন, পুলওয়ামায় হামলার সাথে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পাকিস্তান স্থিতিশীলতার দিকে এগোচ্ছে। এ সময় কেন এমন হামলা করবে পাকিস্তান? তিনি বলেন, কাশ্মিরে কিছু হলেই বিনা প্রমাণে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলে ভারত। এটা ভারতের দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
ইমরান খান বলেন, ভারতে সামনে জাতীয় নির্বাচন রয়েছে। তাই পাকিস্তানবিরোধী জিগির তোলা হচ্ছে। এর বদলে ভারতের উচিত কাশ্মির নীতি নিয়ে আত্মসমালোচনা করা। তাহলেই কাশ্মির সমস্যার সমাধানের পথ তারা পেয়ে যাবে। সেনা দিয়ে যে কাশ্মির সমস্যার সমাধান হবে না তা এতদিনে নয়াদিল্লির বোঝা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন ইমরান খান।
পুলওয়ামায় হামলা নিয়ে ভারতের অভিযোগের জবাবে বিলম্বে নিজের প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যাখ্যা দিয়ে গতকাল ইমরান খান বলেন, ওই হামলায় পাকিস্তানের হাত আছে বলে দিল্লি অভিযোগ করেছে। কিন্তু এমন সময়ে এ অভিযোগ করা হচ্ছে যখন সৌদি আরবের যুবরাজ সালমান পাকিস্তান সফরে আসছেন। যুবরাজের সাথে আমাদের বহুল প্রত্যাশিত বিনিয়োগ সম্মেলন ছিল। তার এ সফরটির জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম।
কাজেই হামলার পরপরই ভারতের দিক থেকে করা অভিযোগের জবাব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমি। সাথে সাথে ভারতের অভিযোগের জবাব দিতে গেলে পুলওয়ামায় হামলার ইস্যুটি আমাদের সামনে বড় হয়ে উঠত। যুবরাজের সফরের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতো। কাজেই ওই সময়ে আমি ভারতের অভিযোগের জবাব না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সফরের পর যুবরাজ পাকিস্তান ছেড়ে চলে গেছেন।
তাই এখন আমি আমার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি এবং আমার এই বার্তাটি ভারত সরকারের উদ্দেশ্যে।
ইমরান খান বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে আপনারা কোনো প্রমাণ ছাড়াই পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করছেন। কিন্তু আপনারা কি কখনো চিন্তা করেছেন যে, এ ধরনের হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের কী লাভ হবে? কোনো বোকাও তো চাইবে না তার নিজের একটি বহুল প্রত্যাশিত সম্মেলন পণ্ড করে দিতে? এমনকি সৌদি যুবরাজ যদি পাকিস্তান সফরে নাও আসতেন তাহলেও পুলওয়ামায় হামলা চালিয়ে পাকিস্তান কী লাভটা অর্জন করত? পাকিস্তান যখন স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এ ধরনের একটি হামলার সাথে আমরা কেন নিজেদের জড়াব? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ১৫ বছর যুদ্ধ করেছে, এ যুদ্ধে আমাদের ৭০ হাজার সৈন্য জীবন দিয়েছেন। এখন পাকিস্তানে সহিংসতার মাত্রা কমে আসছে, স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, তখন আমাদের হঠকারিতার দিকে ফিরে যাওয়ার কোনো মানসিকতা কি থাকতে পারে?
ভারতের উদ্দেশে ইমরান খান আরো বলেন, আপনারা অতীত আকড়ে থাকতে চান এবং যখনই অধিকৃত কাশ্মিরে কোনো ঘটনা ঘটে, সেটার জন্য আপনারা পাকিস্তানকে দায়ী করেন। কাশ্মির সমস্যার সমাধানের চেষ্টার পরিবর্তে, ইস্যুটি নিয়ে সংলাপ বা সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে আপনারা পাকিস্তানকে বারবার আপনাদের চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করতে চান। কিন্তু আমি আপনাদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, এটা নতুন পাকিস্তান, একটা নতুন মাইন্ডসেট নিয়ে, নতুন চিন্তা নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তানের ভূখণ্ডকে আমরা অন্য কোনো দেশে হামলার কাজে কাউকে ব্যবহার করতে দেবো না। অন্য দেশের কেউ আমাদের দেশে এসে সন্ত্রাসী হামলা চালাক সেটাও আমরা চাই না।
ইমরান খান বলেন, আজ আমি ভারত সরকারকে একটি প্রস্তাব দিতে চাই। আর সেটা হচ্ছে, পুলওয়ামায় হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়ে দিল্লি যদি কোনো তদন্ত করতে চায় তাতে সার্বিক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত রয়েছে পাকিস্তান। তিনি আরো বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছি। সন্ত্রাসবাদ একটি আঞ্চলিক ইস্যু। আমরা চাই এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটুক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তান যখনই ভারতের সাথে কোনো আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে তখনই ভারত এর সাথে পূর্বশর্ত হিসেবে সন্ত্রাসবাদকে যুক্ত করেছে। ভারতেরও এখন নতুনভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। অধিকৃত কাশ্মিরের যুবকরা মৃত্যুর ভয় না করে কেন নিজেদের জীবন দিচ্ছে তার যুক্তি তো নিশ্চয়ই আছে। এর মূল কারণ ভারত সরকারকে অনুধাবন করতে হবে।
জাতিসঙ্ঘের প্রতি কোরেশির আহ্বান : পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি তার দেশ ও ভারতের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনে জাতিসঙ্ঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এন্তোনিয়ো গুতেরেজের কাছে লেখা এক চিঠিতে কোরেশি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পুলওয়ামা হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসনে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ করা খুবই জরুরি। কেননা ও হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে।
পাক-ভারত উত্তেজনা নিরসনে কাজ করবে সৌদি আরব : ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে কাজ করবে সৌদি আরব। পাকিস্তান সফর শেষে সৌদি আরবের যুবরাজ সালমানের নয়াদিল্লি যাওয়ার আগে এ কথা বলা হয়েছে দেশটির পক্ষ থেকে। সোমবার সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তারা দেখবেন এসব সঙ্কট শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের কি পথ আছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। তাদের ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। পণ্যের ওপর শতকরা ২০০ ভাগ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে কাশ্মিরের পুলওয়ামায় নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থার মধ্যেই পাকিস্তান সফর করলেন সৌদি যুবরাজ।
কাশ্মিরে অস্ত্র হাতে নিলেই গুলি : মঙ্গলবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে কাশ্মিরবাসীকে। এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে এস ঢিলোঁ সংবাদ সম্মেলনে হুমকি দিয়েছেন, কাশ্মিরে কেউ অস্ত্র হাতে তুলে নিলেই তাকে গুলি করা হবে। তিনি কাশ্মিরে সেনা অভিযানের সময় জনগণকে কোনো ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। জেনারেল ঢিলোঁর এ মন্তব্য ক’দিন আগে করা সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের মন্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। তিনিও সেনা অভিযানে বাধা দিলে কঠোর পরিণতি বরণ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। অভিভাবকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তরুণদের সঠিক পথে ফেরাতে।
মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার মুসলমান : পুলওয়ামার ঘটনার পর কাশ্মিরিদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জম্মু ও কাশ্মিরের মুসলমানরা। উগ্রপন্থী হিন্দুদের হামলা থেকে বাঁচার জন্য কাশ্মিরের বিভিন্ন মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার মুসলমান। ইতোমধ্যে এদের সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে কাশ্মিরের বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বাথিন্দি এলাকার মক্কা মসজিদেই প্রায় ৩ হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে বলে ওই মসজিদ কমিটির সদস্য আব্দুল মজিদ সাংবাদিকদের জানান।
রাজ্যের বারমুল্লা জেলার বাসিন্দা আইজাজ আহমেদ মীর চিকিৎসার জন্য তার স্ত্রীকে নিয়ে চণ্ডিগড় গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, গত রোববার সন্ধ্যায় আমরা জম্মুতে পৌঁছি। এরপর হামলার আশঙ্কায় আমরা মক্কা মসজিদে আশ্রয় নেই। এ ছাড়া খাটিকা তলব এলাকার জামে মসজিদেও প্রায় ২ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বলে খবরে বলা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement