২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে লাখো মুসল্লির ক্ষমার আকুতি

বিশ্ব ইজতেমায় গতকাল প্রথমপর্বের আখেরি মুনাজাত : আবদুল্লাহ আল বাপ্পী -

ইসলাম ও মুসলমানদের হেফাজত, বিশ্বময় শান্তি কামনা, গুনাহ মার্জনা, ঈমানের মজবুতি ও ইজতিমাকে কবুল করার আকুতি জানিয়ে আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ তীরে তাবলিগ জামাতের একাংশের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হয়েছে। গতবারের মতো এবারো আরবি ও বাংলা ভাষায় আখেরি মুনাজাত পরিচালিত হয়। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়ে ১১টা ৭ মিনিটে শেষ হয় ৫৪তম বিশ্ব ইজতিমার প্রথম অংশের মুনাজাত। দীর্ঘ মুনাজাতে তাবলিগের কাকরাইল মারকাজ মসজিদের ঈমাম ও খতিব হাফেজ মুহাম্মদ যোবায়ের মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কায়মনোবাক্যে সব গুনাহ মাফি চেয়ে ইমানি জিন্দিগি কামনা করেন। হকের রাস্তা খুলে দেয়ার আকুতি জানান, দুনিয়া থেকে শিরক ও বিদআতের খতম কামনা করেন। দ্বীনের হিজরত ও মেহনতকে কবুল করার আকুতি জানান। এর আগে বাদ ফজর থেকে উর্দুতে বয়ান করেন মাওলানা ওবায়েদ উল্লাহ খুরশিদ, বাংলায় তরমজা করেন মাওলানা আব্দুল মতিন। আখেরি মুনাজাতের আগে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মো: ইব্রাহিম। বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা যোবায়ের।
আজ রোববার বাদ ফজর থেকে শুরু হবে তাবলিগ জামাতের ওয়াসিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন ভারতের মাওলানা সা’দ অনুসারীদের দুই দিনের ইজতিমা। সোমবার আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে তাদের ইজতিমা। সব জল্পনা-কল্পনা ও অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হলো তাবলিগ জামাতের বৃহত্তর অংশের বিশ্ব ইজতিমা।
গতকাল মূল ধারার তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের শীর্ষ মুরব্বি হাফেজ মুহাম্মদ যোবায়ের সাহেবের মোনাজাত চলাকালে সুবিশাল ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। মুনাজাতে তিনি মহান রাব্বুল ইজ্জতের কাছে যখন কিছু কামনায় আকুতি জানান, সাথে সাথে ময়দান কেঁপে লাখো কণ্ঠে আওয়াজ উঠে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন, ছুম্মা আমিন’। মুসল্লিদের সমম্বরে আমিন ধ্বনি ও কান্নার আওয়াজে ইজতেমা ময়দানে নেমে আসে এক আবেগঘন পরিবেশের। আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে গতকাল ইজতেমা ময়দান ও চার পাশে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ইজতেমা অভিমুখে মুসল্লিরা আসতে শুরু করেন। ফলে টঙ্গী যেন সব পথের মোহনায় পরিণত হয়।
সমগ্র বিশ্বে দাওয়াতে তাবলিগের ব্যাপক প্রসার এবং সব মুসলমানের ঈমানি শক্তি বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে পরিচালিত আখেরি মুনাজাতে শরিক হয়েছেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের সদস্যরা এবং দলমত নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
আবেগঘন আখেরি মোনাজাতে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে রাহমানুর রাহিম আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। দক্ষিণে কুড়িল বিশ্বরোড, উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পূর্বে পূবাইল মিরের বাজার ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত অন্তত ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র থেকে মধ্যাহ্নের আকাশ কাঁপিয়ে ধ্বনি উঠেÑ ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ’। মুঠোফোন, রেডিও ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ একসাথে হাত তুলেছেন পরওয়ারদিগারের শাহী দরবারে। স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ৩২টি দেশের ৫৫৮ জন তাবলিগ অনুসারী ইজতেমায় ও আখেরি মুনাজাতে সরাসরি অংশ নিয়েছেন।
মুনাজাতে যা বলা হয় : হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যোবায়ের মুনাজাতের শুরুতে প্রায় ১৩ মিনিট প্রথমে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত কিছু দোয়ার আয়াত উচ্চারণ করেন এবং পরে বাংলা ভাষায় মুনাজাত পরিচালনা করেন। মুনাজাতে তিনি বলেন, হে আল্লাহ আমাদের অন্তর থেকে কুফরি, মোনাফেকি দূর করে দাও। হে আল্লাহ, তোমার নির্দেশিত পথে চলার তৌফিক দাও। হে আল্লাহ, আমাদের সব নেক হাজাত পূরণ করে দাও। হে রাহমানুর রাহিম আমাদের ওপর রহম করো।
কায়মনোবক্যে আকুতি জানিয়ে মুনাজতে বলা হয়, হে আল্লাহ তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেইতো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের ওপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। নবীওয়ালা জিন্দেগি আমাদের নসিব করো। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, হে আল্লাহ, দাওয়াতে তাবলিগকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করুন। এ কাজকে আপনি হেফাজত করুন। আমাদের আমল-আখলাক সুন্দর করে দিন। মুসলমানদের জান-মাল-ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করুন। দ্বীনের ভেতর মহব্বত পয়দা করে দিন। সবাইকে এক করে দিন।
ইজতেমায় ভিআইপিদের অংশগ্রহণ : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো: আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো: জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, আব্দুল মতিন খসরু, গাজীপুর সিটি মেয়র অ্যাডভোকেট মো: জাহাঙ্গীর আলম, জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, গাজীপুর পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমানসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের পদস্থ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ইজতিমায় উপস্থিত থিকে মোনাজাতে শরিক হন।
ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প : গাজীপুর সিটি করপোরেশন, হামদর্দ, ইবনে সিনা, ইসলামিক মিশন, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, জহিরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, হাফেজি হুজুর সেবা সংস্থা, হোমিওপ্যাথিক ওয়েলফেয়ার, বাংলাদেশ ইউনানি-আয়ুর্বেদিক, বঙ্গবন্ধু ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পসহ বেশ কিছু সংগঠন ইজতেমা ময়দানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
আরো দুই মুসল্লির মৃত্যু : ইজতেমায় আগত আরো দুই মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। ঢাকার কদমতলা এলাকার মো: আবুল হোসেন (৫৫) শনিবার ভোর ৫টার দিকে নিজ খিত্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি। এর আগে শুক্রবার দুপুরে আব্দুর রহমান (৫৫) নামে আরো এক মুসল্লি মারা যান। তিনি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মৃত হাতেম আলীর ছেলে। ইজতেমা মাঠে নামাজে জানাজা শেষে তাদের লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মুসল্লিদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার : গতকাল সমগ্র দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল টঙ্গীর দিকে। টঙ্গী হয়ে উঠে ছিল সব পথের মোহনা। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা টঙ্গী অভিমুখে ছুটতে থাকেন শুক্রবার থেকে। রাজধানীসহ পাশের এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে নানা ঝক্কিঝামেলা উপেক্ষা করে রাতেই টঙ্গীমুখো হন। টঙ্গী, গাজীপুর ও রাজধানী ঢাকার সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ। আগের মধ্যরাত থেকে টঙ্গীমুখী সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ রাতেই ইজতেমার মাঠ কিংবা আশপাশের বাসা-বাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদ কিংবা করিডোরে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নেন। গতকাল ভোর থেকে যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথে টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়। সকাল ৮টার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। এ দিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে আগের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মহিলাকে মাইলের পর মাইল হেঁটে টঙ্গী পৌঁছে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। আখেরি মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদফতরের উদ্যোগে আবদুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিসের উদ্যোগে ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগ আলী, টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন, স্টেশন রোড, টঙ্গী বাজার আনারকলি রোড ও আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়।
মোবাইল নেটওয়ার্ক : গতকাল ইজতেমা ময়দান ও টঙ্গী থেকে কোনো মোবাইলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নেটওয়ার্ক যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যে লাইন পেলেও মুহূর্তেই কেটে যাচ্ছিল। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো নেটওয়ার্ক সুবিধা দিতে ইজতেমা উপলক্ষে ইজতেমার আশপাশ এলাকায় অতিরিক্ত মোবাইল টাওয়ার সংযোগ করেও এ সমস্যার পুরো সমাধান দিতে পারেনি।
এবারই সবচেয়ে কম বিদেশী মুসল্লি : সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সবচেয়ে কম বিদেশী বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেন। মাত্র ৩৮টি দেশের ৫৫৮ জন বিদেশী মুসল্লি এবারের ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের মুসল্লির সংখ্যাই বেশি।
২০২০ সালের বিশ^ ইজতেমা : ২০২০ সালের বিশ^ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে প্রথম পর্ব ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি। দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি। মাওলানা যোবায়ের পন্থীদের পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা হবে চলতি বছরের ৯ ও ৩০ নভেম্বর এবং ১, ২ ও ৩ ডিসেম্বর বলে জানিয়েছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান।


আরো সংবাদ



premium cement