‘কেউ কি আরেকটি সোনালী কাবিন লিখতে পেরেছে ?’

সোনালী কাবিন শব্দ দুটো উচ্চারণ করলেই যার নাম সামনে আসে, তিনি হচ্ছেন কবি আল মাহমুদ। গত ৫০ বছর ধরে বাংলা কবিতার জগতে আলোড়ন তুলেছেন এই কবি। সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি।
কবিতা, গল্প ও উপন্যাসÑ সব শাখাতেই তার বিচরণ থাকলেও, আল মাহমুদ মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তুসোনালী কাবিন আল মাহমুদকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। আল মাহমুদের কবিতা বাংলাদেশের অনেক কবিকে প্রভাবিত করেছিল। এদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী অন্যতম। আল মাহমুদের কবিতা শুধু তাকেই নয়, বহু পাঠককে প্রভাবিত করেছে।
বিবিসিকে আসাদ চৌধুরী বলেন, আমি অজস্র মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি সোনালী কাবিন তাদের মুখস্থ। আল মাহমুদের কবিতার বিষয় হিসেবে প্রথম দিকে গ্রামের জীবন, বামপন্থী চিন্তধারা ও নারী মুখ্য হয়ে উঠলেও পরে ইসলামী ভাবধারাও প্রবল হয়ে ওঠে।
আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাম ধারা দেখা গেলেও ১৯৭৪ সালের পর থেকে তার কবিতায় ইসলামী ভাবধারাও লক্ষ করা যায়।
১৯৭২ সালে আল মাহমুদ তৎকালীন গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যে পত্রিকাটির মালিকানা ছিল জাসদের এবং সেটি সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিল। আল মাহমুদের সম্পাদনায় তখন গণকণ্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি মনে করেন, আল মাহমুদ গণকণ্ঠের সম্পাদক থাকলেও তার দলীয় কোনো পরিচয় ছিল না। রাজনৈতিক দল জাসদের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও আল মাহমুদ কখনো সরাসরি রাজনীতিতে জড়াননি।
১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জাসদের উদ্যোগে ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেয়ে হয়। সেদিন রাতেই তৎকালীন গণকণ্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জাসদ গণকণ্ঠের মালিক ছিল বলে আল মাহমুদ ভিকটিম হলেন। এবং তিনি অনেক দিন বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন।’
মহিউদ্দিন আহমেদের বর্ণনায় জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ‘অন্যরকম এক আল মাহমুদের’ দেখা মিলল। তখন আল মাহমুদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
আল মাহমুদ কবি হলেও তিনি নিজেকে রাজনৈতিক দর্শন থেকে দূরে রাখেননি। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, কবি আসাদ চৌধুরী আল মাহমুদকে বিচার করেন তার লেখা ও শিল্পের বিচারে। শুরুর দিকে বামপন্থী চিন্তাধারার হলেও, সেখান থেকে সরে এসে আল মাহমুদ কেন ইসলামী ভাবধারার দিকে ঝুঁকলেন? ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
আল মাহমুদ সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি কখনো মার্কসবাদী ছিলেন না বরং তার চরিত্রে এক ধরনের দোদুল্যমানতা ছিল। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমি যে পরিবারে জন্মেছি তারা সবাই ছিলেন খুবই ধর্মপ্রবণ লোক। কিভাবে যেন তাদের মধ্যেই যে রয়েছে সত্যিকারের পথের ঠিকানা এটা আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকত।’
আসাদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো তারও ক্ষোভ বেশি ছিল এবং ক্ষোভের প্রকাশটা রাজনৈতিক আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যেটা অনেকে পছন্দ করেননি। কিন্তু শিল্পীকে বিচার করতে হয় শিল্পের মাপকাঠিতে। আল মাহমুদকে বিচার করতে হবে তার কবিতা দিয়ে।’
কবি হলেও আল মাহমুদ বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। কিন্তু বরাবরই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন তার কবিতাকে। লোক-লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিনÑ একের পর এক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আল মাহমুদ সবসময় দাবি করতেনÑ তিনি একজন কবি। তিনি কখনোই বলেননি যে তিনি একজন সম্পাদক।’ তিনি সব সময় চাইতেন তাকে তার কবিতা দিয়েই মূল্যায়ন করা হোক। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, একবার মাহমুদ ভাই একটা কথা বলেছিলেন, যেটা এখনো আমার কানে ভাসে। সেটা হলোÑ আর কেউ কি আরেকটি সোনালী কাবিন লিখতে পেরেছে?
১৯৫০ সালের পর বাংলা সাহিত্যে যত কবির আবির্ভাব হয়েছে, শিল্পমান ও লেখার বিচারে বিশ্লেষকেরা আল মাহমুদকে সন্দেহাতীতভাবে প্রথম সারিতেই রাখছেন।