২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিশ্ব ইজতেমায় জুমার জামাতে জনসমুদ্র

শরিক হলেন আল্লামা শফী
টঙ্গীতে ইজতেমায় আগতদের জুমার নামাজ আদায় : নয়া দিগন্ত -

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে টঙ্গীতে টানা চার দিনব্যাপী তাবলিগ জামাতের ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা গতকাল শুক্রবার শুরু হয়েছে। শীত আর নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে তাবলিগ জামাতের এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সাদ অনুসারীদের দুই দিন করে পৃথক ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এবারের বিশ্ব ইজতেমায় দু’টি আখেরি মুনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার হতে শুরু হওয়া প্রথম ধাপের ইজতেমা শনিবার আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। প্রথম ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন জোবায়েরপন্থী আলেম-ওলামা কওমিপন্থী তাবলিগ অনুসারীগণ। দ্বিতীয় ধাপের নেতৃত্বে থাকছেন সা’দ অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তাবলিগ অনুসারীরা। এ দিকে হেফাজত ইসলাম প্রধান আল্লামা আহমদ শফী ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়ে জুমার নামাজে শরিক হন। তিনি শনিবার আখেরি মুনাজাত পর্যন্ত ইজতেমা মাঠে অবস্থান করবেন। জুমাবার হওয়ায় সকাল থেকেই টঙ্গী ও আশপাশ এলাকার লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষের ঢল নামে টঙ্গীর তুরাগতীরে। নামাজের আগেই ইজতেমার পুরো প্যান্ডেল ও ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা অংশ নেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ আশপাশের সড়ক ও গলিগুলোর ওপরে। আখেরি মুনাজাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। প্রথম দিনে বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকে জোবায়ের অনুসারীদের বিশ^ ইজতেমার বয়ান শুরু হয়। আজ শনিবার আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম দু’দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে। অন্যান্য বছরের মতো এবারো উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে যথারীতি তাবলিগের ৬ উসুল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহিহ নিয়ত ও তাবলিগ ইত্যাদি বিষয়ে আমবয়ানের মাধ্যমে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়।
ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা : বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরব্বি প্রকৌশলী মো: মাহফুজুর রহমান জানান, শুক্রবার বাদ ফজর উর্দুতে চূড়ান্ত আমবয়ানের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক মূল বয়ান শুরু করেন। আর বাংলাদেশের নোয়াখালীর মাওলানা নূরুর রহমান তা বাংলায় তরজমা করেন। ইজতেমাস্থলের বয়ানমঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দুতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ২৪টি ভাষায় তা তরজমা হচ্ছে। পরে তাবলিগ মারকাজের শূরা সদস্য ও বুর্জুগরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত স¤পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়।
আয়োজকরা বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচির মধ্যে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কুরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানোসহ নতুন জামাত তৈরি হবে। তবে এ বছরও যৌতুকবিহীন বিয়ে হবে না।
আজ (শনিবার) মাওলানা জোবায়ের অনুসারীগণের আখেরি মুনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মুনাজাত শেষে জোবায়ের অনুসারীগণ ময়দান ছেড়ে চলে গেলে রোববার থেকে মাওলানা সা’দ অনুসারীদের পরিচালনায় ইজতেমা ফের শুরু হবে। সোমবার মাওলানা সাদপন্থীদের আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এ পর্বের চার দিনের বিশ^ ইজতেমা।
বয়ান : শুক্রবার বয়ানে বলা হয়, ‘পৃথিবীতে ঈমানের মূল্য অনেক বেশি। ঈমানকে মজবুত করতে হলে আমাদের দাওয়াতি কাজে সময় লাগাতে হবে। আমরা যেন আল্লাহপাকের হুকুমমতো সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দ্বীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে। দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। নিজের আমল দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা: যে কাজে খুশি হন তা আমাদের বেশি বেশি করতে হবে। আমাদের সবার আখেরাতের চিরস্থায়ী জিন্দেগির জন্য আবাদ করতে হবে।’
জুমার নামাজে লাখো মুসল্লি : বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিনে স্মরণকালের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে জুমার জামাত শুরু হয়। জুমার নামাজের ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের।
জুমার নামাজে ঢাকা, সাভার, গাজীপুরসহ আশপাশ এলাকার লাখ লাখ মানুষ যোগ দেন। ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশপাশ এলাকা থেকে ইজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে।
বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠের দিকে ছুটে আসেন জুমার নামাজ আদায় করার জন্য। মাঠে স্থান না পেয়ে মুসল্লিরা মহাসড়ক ও অলি-গলিসহ যে যেখানে পেরেছেন পেপার, চটের বস্তা, হোগলা পাটি বিছিয়ে নামাজে শরিক হন। এ দিকে রাস্তায় নামাজ আদায়ের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক বন্ধ থাকে।
এ দিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির ও গাজীপুর মেট্রো পুলিশ কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজম উল্লাহ খানসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজে শরিক হন। এ দিকে দুপুরের আগে অনেকটা হঠাৎ করে হেফাজতে ইসলাম প্রধান হজরত মাওলানা আল্লামা শফী হুজুর ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়ে জুমার নামাজে শরিক হন।
এ ছাড়াও সা’দবিরোধী হিসেবে পরিচিত তাবলিগের একটি অংশ মাওলানা আহম্মেদ লাটসহ তার সফরসঙ্গীরা বৃহস্পতিবার দুপুরে ইজতেমা মাঠে এসে পৌঁছেছেন। তিনি ইজতেমা ময়দানে বয়ানও করেছেন।
ইজতেমায় শরিক হলেন আল্লামা শফী : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী শুক্রবার জুমার নামাজে শরিক হন। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইছাখালী থেকে বেসরকারি হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় বিমান টঙ্গীর বাটা সু কারখানা এলাকার হেলিপ্যাডে নামেন। পরে সেখান থেকে তিনি নিজ গাড়িতে করে ইজতেমায় ময়দানে নির্দিষ্ট কামড়ায় পৌঁছে দেন তাকে। শনিবার আখেরি মুনাজাতেও শরিক হবেন এবং হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে ফিরবেন।
সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আতঙ্কে আহত ২০ : টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় ময়দানে বয়ানমঞ্চের দক্ষিণে রান্না করার সময় শুক্রবার সকালে একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের গুজবে আতঙ্কিত হয়ে মুসল্লিরা ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় আশাপাশে রান্না চলাকালে চুলার গরম হাঁড়ি-পাতিল পড়ে গিয়ে চুলার আগুনে পুড়ে ও দা-বঁটিতে কাটা পড়ে কমপক্ষে ২০ মুসল্লি আহত হয়েছেন। শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় এ ঘটনা ঘটে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো: আজাদ মিয়া জানান, বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে রান্না করার সময় গ্যাস সিলিন্ডারের চুলা থেকে শব্দ হয়। এ সময় আশপাশে থাকা মুসল্লিরা আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। এতে প্রায় ১৫-২০ জন মুসল্লি আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন আগুনে ও গরম বস্তুতে দগ্ধ হয়ে এবং কয়েকজন দা-বঁটিতে কাটা পড়ে আহত হয়েছেন। আহতদের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে এবং স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
র্যাব-১-এর স্পেশালাইজ কোম্পানি পোড়াবাড়ি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, ওই ঘটনায় আহত ও দগ্ধ কয়েকজন মুসল্লি র্যাবের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজশাহীর হাসান মাহমুদ, খুলনার খালিদ হাসান, টাঙ্গাইলের জাবেদ শিকদার, রাজশাহীর জোবায়ের, জামালপুরের নজরুল ইসলাম, ঢাকার সাভারের মনিরুজ্জামান, রাজশাহীর হারুন অর রশিদ, লক্ষ্মীপুরের জাহিদ, সিরাগঞ্জের জাহিদুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর মুজাহিদুল ইসলাম, ওমায়ের, বরিশালের আরিফুল ইসলাম, ময়মনসিংহের আজাহারুল ইসলাম র্যাবের ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আরো দুইজনের মৃত্যু : টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আরো দুই মুসল্লি মারা গেছেন। তারা হলেনÑ ফেনীর সফিকুর রহমান (৫৮) এবং কুষ্টিয়ার মো: সিরাজুল ইসলাম (৬৫)। বিশ্ব ইজতেমার মাসলেহাল জামাতের জিম্মাদার জানান, শুক্রবার ভোরে পৌনে ৫টার দিকে সফিকুর রহমান এবং বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে সিরাজুল ইসলাম মারা গেছেন। এর আগে ১৪ ফেব্রয়ারি দুই জন মারা যান। এ নিয়ে গত দুই দিনে চারজন মুসল্লির মৃত্যু হলো।
বিদেশী মেহমান : পুলিশের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, ইজতেমার প্রথম দিনে আমেরিকা, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, লেবানন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের ৮০টি দেশের মানুষ অংশ নিয়েছেন।
তবে ইজতেমা ময়দানে নিরাপত্তা রক্ষার কাজে দায়িত্বপালনরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এবার দেশী অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়লেও বিদেশীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। তবে পাসপোর্টের হিসাবমতে ২৪টি দেশ থেকে ৩০১ জন বিদেশী ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা। কিন্তু বিগত ইজতেমাগুলোতে শুরুর দিনে বিদেশীর সংখ্যা ৭-৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তবে গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, এবার বিদেশীর সংখ্যা এক হাজারের মতো হতে পারে।
ইজতেমার মুরব্বিদের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে ইজতেমার আয়োজন শুরু করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বর্তমানস্থলে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সরকারিভাবে তুরাগতীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।


আরো সংবাদ



premium cement