২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিএনপিতে পুনর্গঠনের হাওয়া

শীর্ষ নেতারাই দাবি তুলেছেন পরিবর্তনের ; স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের চিন্তা ; শিগগিরই কাউন্সিল হচ্ছে না
-

বিএনপিতে পুনর্গঠনের হাওয়া বইছে। শীর্ষ নেতারাই দাবি তুলেছেন পরিবর্তনের। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পটভূমিতে নেতৃত্বের ব্যর্থতা-সফলতা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। জাতীয় কাউন্সিল করে নেতৃত্ব ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব উঠেছে। নতুনরূপে বিএনপিকে দেখতে চান হতাশ ও বিপর্যস্ত তৃণমূল নেতারাও। তবে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ থাকায় যথাসময়ে কাউন্সিল করা নিয়ে নেতাদের মধ্যে মতদ্বৈততা রয়েছে। এক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের মুক্ত করে একটি ‘স্বাভাবিক পরিবেশে’ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের পক্ষে পাল্লাই ভারী। লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে নির্বাচনের পর গত দুই সপ্তাহে দলের বিভিন্নপর্যায়ের নেতাদের সিরিজ বৈঠক ডেকে স্কাইপিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনিও দলকে নতুন করে সাজাতে চান বলে জানা গেছে। তবে তড়িঘড়ি করে নয়। সারা দেশে সংগঠনের বর্তমান অবস্থার সার্বিক চিত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন তিনি।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভবিষ্যৎ সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক করণীয় নির্ধারণে এ পর্যন্ত দুই দফা বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, এসব বৈঠকে দল পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কাউন্সিলের প্রস্তাবও এসেছে। গত সপ্তাহে জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অত্যন্ত শক্তভাবে দলপুনর্গঠনের কথা বলেছেন। তারা যদি ব্যর্থ হন, পদ ছেড়ে দিতেও রাজি আছেন বলে এ সময় তারা নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করেন।
জানা গেছে, দলকে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার পথে যথাযথ রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে কি না তা নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে দ্বিমত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের লাভ-ক্ষতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একাধিক সদস্য ঐক্যফ্রন্টের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন। ওই বৈঠকের দুই দিন পর ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি না থাকায় আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্পষ্ট করে বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টে কোনো বিভেদ নেই।
জানা গেছে, দল পুনর্গঠনের দাবি উঠলেও কিভাবে শুরু হবে তা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নেতাকর্মীদের চাহিদার আলোকে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে লন্ডনে তারেক রহমানের কাছে বার্তা দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা পরামর্শ আসার আগ পর্যন্ত নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। অন্তত আগামী ছয় মাস তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক নির্দেশনা পর্যবেক্ষণ করার কথা ভাবছেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমান সারা দেশে দলের বর্তমান অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন তিনি। মহানগর, জেলা, থানাসহ কোন ইউনিটের কী অবস্থা তা তিনি অবহিত হচ্ছেন। নতুনভাবে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবেই তিনি এ কাজে হাত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ জানিয়েছেন, ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে ঢুকানো হয়েছে। লক্ষাধিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন। এ অবস্থায় নেত্রীর মুক্তি নিশ্চিত করে একটি স্বাভাবিক পরিবেশে শীর্ষ নেতারা দল গোছানোর কাজ শুরু করতে চান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ জাতীয় কাউন্সিল করেছিল বিএনপি। কিন্তু তিন বছরের মেয়াদের প্রায় শেষপর্যায়ে এসেও কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি দলটি। বিষয়ভিত্তিক কমিটি গঠন আলোর মুখ দেখেনি। এক নেতার এক পদ করার বিধি সবক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির দু’টি পদ ঘোষণার সময়ই ফাঁকা ছিল। বাকি ১৭ সদস্যের মধ্যে তিন সদস্য মারা গেছেন। বর্তমানে পাঁচটি পদ ফাঁকা। এ ছাড়া, অসুস্থতা, বিদেশে থাকা ও কারাগারে থাকার কারণে আরো চার নেতা বলতে গেলে অনুপস্থিত। উপদেষ্টা পরিষদেরও কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। বয়সের কারণে অনেকে নিষ্ক্রিয়। বয়স, সাজা, দলত্যাগসহ বিভিন্ন কারণে অনেক ভাইস চেয়ারম্যানও নিষ্ক্রিয়। যুগ্মমহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা এবং অনেকেই কারাগারে থাকার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন না। মৃত্যু, বয়স-মামলাসহ নানা কারণে সম্পাদক মণ্ডলী ও নির্বাহী কমিটির অনেক সদস্যও সংগঠনের তেমন কোনো কাজে আসছে না। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় কমিটির মতোই বেহাল দশা ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর। এক মাসের সময় দিয়ে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের আংশিক কমিটি দেয়া হলেও বছর পর বছরে তা পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এ অবস্থায় দলকে ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প দেখছে না হাইকমান্ড। জানা গেছে, সহসা কাউন্সিল না হলেও স্থায়ী কমিটি ও নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের চিন্তা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাহিদা কী, তা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তৃণমূলের চাহিদা অনুসন্ধানে প্রথম বিষয়টি বের হয়ে এসেছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। সবার আগে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়ে কোনো নেতাকর্মীর দ্বিমত নেই। এ জন্য, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন বেগবান করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর এক বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ রেখে আইনি লড়াইসহ মুক্তি আন্দোলন বেগবান করা হবে।
তৃণমূলের নেতাদের দাবিÑ বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দ্রুত দল পুনর্গঠন করতে হবে। বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, বিএনপির তৃণমূল সংগঠন এখনো ঐক্যবদ্ধ। তারা ত্যাগ স্বীকার করে আসছে, আগামীতেও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। কিন্তু এই মুহূর্তে সঠিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। যারা দলকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। নীতিনির্ধারণীপর্যায়ে এই পরিবর্তন আনা জরুরি।
যুবদল নেতা মাহবুবুল হাসান পিঙ্কু বলেন, নিষ্ক্রিয়দের বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্বের সামনের সারিতে আনতে হবে। সংগঠনের প্রতিটি ইউনিটের নেতা নির্বাচিত করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে। নেতা হতে হবে কর্মীদের চাহিদামাফিক।
এ দিকে, আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়েও তৃণমূলের মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হবে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের অংশ না নেয়ার। তবে তৃণমূলের কেউ যদি নির্বাচন করতে চায় সে ক্ষেত্রে তাকে বাধা দেয়া হবে না। তবে তাকে দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement