২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

গন্তব্য স্পষ্ট করতে চায় বিএনপি

লক্ষ্য আন্তর্জাতিক জনমতকে কর্মপদক্ষেপে রূপান্তর; দলের কাঠামো শক্তিশালী করা; বাইরের মিত্রদের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি
-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি কোন ধারায় চলবে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের মোকাবেলা করে বিএনপি কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে দলটির নেতাকর্মীদের কাছে সেটাই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। দলের রাজনীতির প্রাণপুরুষ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবার ও আদর্শকে সামনে রেখেই এই চিন্তা করা হচ্ছে। দলের পুনর্গঠন, ত্যাগী ও আদর্শবাদী নেতাদের দায়িত্বে নিয়ে আসা এবং ক্ষমতাবানদের নানামুখী ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে একটি লক্ষ্যে দলকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করা হচ্ছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৮৩তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে দলের বিভিন্ন নেতার সাথে কথা বলে এ ধারণা পাওয়া গেছে।
গত ১২ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দলের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থনের কথা বিভিন্ন জনমত জরিপে প্রকাশ হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ব্যাপক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনে জিতে তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। গত এক যুগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভেতর থেকেই বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে। ঐতিহ্যগত রাজনীতির যে ধারা যুগের পর যুগ চলে এসেছে এখন আর তা নেই। কর্মসূচি ভিত্তিক যে রাজনীতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে জনগণ দেখেছে সেসব এখন বাসি হয়ে গেছে। রাজনীতির নতুন এই আঙ্গিকে বিএনপির মতো দলের গন্তব্য কোথায় কিংবা তারা ঠিক কী করবে তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট হচ্ছে না। বিএনপি নেতৃত্ব এখন সেই গন্তব্যের স্পষ্ট অবয়ব দিতে চাইছে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে তারা স্বীকার করেন, এ দেশের রাজনীতির গতিপথ এখন পাল্টে গেছে। আন্তর্জাতিক চাপ, সুশাসন, গণতন্ত্র এসব নিয়ে সমাজ কাঠামোর ভেতরে যে চিন্তাভাবনা যুগের পর যুগ চলেছে তা এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রণমূলক রাজনীতির নতুন সংজ্ঞায় ‘গণতন্ত্রের’ নবযাত্রা শুরু হয়েছে। এখানে উন্নয়নকেই রাজনীতির লক্ষ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিএনপির মতো ক্ষমতাকেন্দ্রিক গণপ্রকৃতির রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্র চর্চার বাইরে গিয়ে খুব কমই করার আছে। নতুন অবস্থায় জনসমর্থন মুখ্য বিবেচনা হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন উদার গণতান্ত্রিক দেশের পরিবর্তে উন্নয়নমূলক রাজনীতি চর্চাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। চীন, রাশিয়া, কম্পোডিয়া, সিঙ্গাপুর, মিসরের মতো নিয়ন্ত্রণমূলক রাজনীতি চর্চাকারী কয়েকটি দেশই এ ক্ষেত্রে মডেল। রাজনীতির নতুন এই রূপ নিকট অতীতে বাংলাদেশে ছিল না। সরকারের মতের বাইরে মুক্তভাবে কোনো কিছু চিন্তা করার অবকাশ এখন খুবই কম বলেই মনে হচ্ছে। জনমতের বাইরে নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির বিপক্ষে যাওয়ার পর এ নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কিংবা ঐক্যফ্রন্টের এখনো ব্যাপক জনসমর্থন আছে। কিন্তু সে জনসমর্থন কাজে লাগানোর মতো কোনো শক্তি কিংবা ম্যাকানিজম এখন নেই। ফলে তারা এমন কৌশলে অগ্রসর হতে চাইছে যাতে বাধাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। তা ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অর্গানই এখন যেভাবে সরকারের রাজনৈতিক আনুগত্য করছে সেটাকেও বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশে অতীতে কখনোই এমন অবস্থা দেখা যায়নি। আগে সরকারকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলে বহু ভেবেচিন্তে নিতে হতো। জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্র কাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা ভাবতে হতো। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি নেই। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই অবাস্তবায়িত কিংবা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা কেউ ভাবছে না। ফলে রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রমূলক ব্যবস্থা আরো পোক্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের অবস্থায় সাংগঠনিক শক্তিকে জোরদার করার কথা বিশেষভাবে ভাবছে বিএনপি নেতৃত্ব। এ জন্য বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর কাউন্সিল অনুষ্ঠান এবং কমিটি গঠনের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
বিএনপির পর্যালোচনায় বলা হচ্ছে, ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে সরকারের নিপীড়নমূলক অবস্থানে বিএনপির জনসমর্থন অনেক বাড়লেও দলটি সাংগঠনিকভাবে বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। মামলা, হামলা এবং জবরদস্তিমূলক শাসনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দলটির উপর। বিভিন্নপর্যায়ে জোরালো নেতৃত্বের অভাবে দল চলছে অনেকটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এতে সাংগঠনিক কাঠামোও দুর্বল হয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি বিদেশীদের উপর অনেকটাই আশা করেছিল যে তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কার্যকর চাপ প্রয়োগ করবে। আর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারা ভালো ফলাফল করতে পারবে। কিন্তু কোনো চাপই সেভাবে কার্যকর হয়নি। এই বাস্তবতার কারণে বিএনপি নেতৃত্ব এখন বাইরের অংশীদারদের সাথে সম্পর্ককে কাঠামোগত রূপ দেয়ার কথা ভাবছে।
এবারের নির্বাচনের ঘোষিত ফল আওয়ামী লীগের জন্য আগের চেয়ে ভালো। সরকার রাশিয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার প্রধান দুই শক্তি ভারত ও চীনকে সমান্তরালভাবে আস্থায় নিয়ে পুরো পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। সমর্থন পেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলোরও। এটি অনেকটা বিস্ময়কর ও অভাবিত। নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। কিন্তু এই উদ্বেগের কার্যকর মূল্য কতটুকু সেটি পর্যবেক্ষণ করার বিষয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও তার মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু সে যোগাযোগ শেষ পর্যন্ত কার্যকর ফল বয়ে আনেনি। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে, সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন বিএনপি নেতৃত্ব যোগাযোগের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে চাইছে। নির্ভর করার মতো সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছে বাইরের শক্তিগুলোর সাথে।
বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক জটিল সমীকরণে চলছে। বিএনপিকে কার্যকর নেতৃত্বহীন (পড়–ন জিয়া পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত) করার চেষ্টা অনেক দূর এগিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব বারবার সিদ্ধান্ত নিয়েও মাঠের চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায় করে নির্বাচনে যেতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে সাজানো প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন না এনেই তারা নির্বাচনে গেছে। নির্বাচন একতরফা করা এবং আগের রাতে সিল মারার আয়োজনের পরও রাস্তায় এর প্রতিবাদ তৈরি করতে পারেনি। ফলে রাজনীতির মাঠ এককভাবে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশীদের পর্যবেক্ষণেও স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে তা আসলে জনগণের মত প্রকাশের নির্বাচন নয়। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবও বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। বিরোধী দল এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি কূটনৈতিক অংশীদারদের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে। বিশ্ব¦ মিডিয়ায় এক ধরনের মতও তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের উদার গণতান্ত্রিক চর্চার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে উত্তর কোরিয়ার গণতন্ত্রের সাথেও তুলনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের এই উৎকণ্ঠা উদ্বেগকে কর্মপদক্ষেপে রূপান্তরের জন্য কাঠামোগতভাবে প্রচেষ্টা চালানো গেলে এর একটি ফল আসতে পারে বলে আশাবাদী বিএনপির নীতি নির্ধারকরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement