২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র কতটা ক্ষতিগ্রস্ত?

-

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এরই নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অসংখ্য অভিযোগ করছেন ভোটাররা। যদিও ক্ষমতাসীনরা বলছেন, এসব প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু নির্বাচনের পর ব্রিটেনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে?
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা ভোটের আগের রাতেই বাক্সভর্তি করে রাখা, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা এবং কেন্দ্র দখল করা। ২০১৪ সালে একটি একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনের পর ২০১৮ সালে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে যে চিত্র দেখা গেছে, সেটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনটিই মনে করছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পর্যাপ্ত পেয়েছেন, এটি বলা যাবে না। এ প্রশ্নটা থেকেই যাবে সবসময় যে সত্যিকার অর্থে এটি কতটা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার। যদি এ ধরনের নির্বাচনটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না।’
বাংলাদেশে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে পরাজিত দল বরাবরই অভিযোগ তুললেও সাধারণভাবে সেসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে কি না সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সর্বশেষ নির্বাচনের পর এ প্রশ্ন আরো জোরালো রূপ নিয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন মনে করেন, সর্বশেষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাওয়ার দশা হয়েছে। ফলে গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। ‘আমার কাছে মনে হয়, নির্বাচনের বদলে এখানে কার্যত হয়েছে সিলেকশন। এটি গণতন্ত্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হচ্ছে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। এ জন্য আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করার জায়গাটি ক্রমেই সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে,’ বলছিলেন জোবাইদা নাসরিন।
বাংলাদেশে কার্যকরী গণতন্ত্র আছে কি না এটি নিয়ে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পশ্চিমা মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে বলেছে, বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।
সর্বশেষ নির্বাচনের পর যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তারা বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। হাইব্রিড রেজিমের কিছু বৈশিষ্ট্য তারা তুলে ধরেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, বিরোধী দল এবং প্রার্থীর ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা; দুর্নীতির বিস্তার প্রায় সর্বত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুর্বল; সিভিল সোসাইটি দুর্বল; সাধারণত সাংবাদিকেরা সেখানে হয়রানি ও চাপের মুখে থাকেন এবং বিচারব্যবস্থাও স্বাধীন নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন, নির্বাচনের মান কতটা ভালো সেটির ওপর নির্ভর করে অনেক কিছু। তিনি বলেন, ‘যখন আমাদের এক-এগারো সরকার এলো তখন আমাদেরকে ওরা আর ডেমোক্র্যাসির ভেতরে ধরেনি। আবার ২০০৮ এর নির্বাচনের পরে আমরা ঢুকেছিলাম। তারপর আবার ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং এবারের নির্বাচন এমন হয়েছে যে এখন আমরা আবার প্রশ্নের সামনে পড়ছি। আমরা যদি ভবিষ্যতে একটা ক্রেডিবল ইলেকশন করতে পারি, তাহলে আমরা আবার ডেমোক্র্যাসির ক্লাবের মধ্যে ঢুকতে পারব।’
বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন নিয়ে অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম সমালোচনা করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের সম্পাদকীয়তে এ নির্বাচনকে প্রহসন বলে বর্ণনা করেছে। অন্য দিকে সিএনএন এ নির্বাচনকে বিতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপজ্জনক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। যদিও নির্বাচনের পর ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ অতি দ্রুত অভিনন্দন জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্য দিকে ইউরোপ ও আমেরিকা ততটা সমালোচনা করেনি, যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ নির্বাচনের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ কিভাবে দেখা হবে? উত্তরে তিনি বলেন,
“গ্লোবাল ইমেজটা দু’ভাবে নির্ধারিত হয়। একটি হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সিভিল সোসাইটি কিভাবে ইমেজটা নির্ধারণ করছে, আরেকটি হচ্ছে সরকারগুলো কিভাবে দেখছে। গ্লোবাল সিভিল সোসাইটির কাছে নির্বাচন নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ।”
তবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে, নির্বাচনের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই।
এমনকি ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজেদের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। আ’লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। যদিও কেউ কেউ বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।... টিআইবি কার কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছে জানি না। এমনও তো হতে পারে তারা সাক্ষাৎকার নিয়েছে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কাছ থেকে।’
তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই ক্ষমতাসীনদের সাথে একমত নন। এ নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি টেস্ট কেস ছিল। কারণ গত ২৭ বছরের মধ্যে এবারই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের অধীনে ভালো নির্বাচন হতে পারে, এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব। এমন নয় যে একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সে উদাহরণ আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বর্ণবাদের সমস্যা কাটিয়ে দেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে একটি অভিনব বিষয় হলো ভোট জালিয়াতি করতে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ক্ষমতাসীনদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ অভিযোগ বেশ জোরালো। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, এটিও গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় অনেক অনৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া, সেসব প্রতিষ্ঠান অনিয়মের সাথে জড়িত থেকেছে। এটি কোনো দেশের গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতীতে বিভিন্ন সময় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও বাংলাদেশ যে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হয়েছে সেটি বলা যাবে না। কারণ সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য গণতন্ত্রের ধারাকে শক্তিশালী হতে দেয়নি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই পূরণ করতে পারল না বাংলাদেশ।


আরো সংবাদ



premium cement