২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সহকারী অধ্যাপকের পর পদোন্নতি নেই

প্রভাষকেই জীবন পার বেসরকারি কলেজের অনেক শিক্ষকের

শিক্ষায় বৈষম্য (১)
-

খালেদ আব্দুল্লাহ হাসান ব্রাহ্মহ্মণবাড়িয়ার কসবা টি আলী কলেজের প্রভাষক। আগামী বছরের জানুয়ারিতে তার চাকরি শেষ হবে। এটা নিশ্চিত যে, তার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। এর কারণ, একটি কলেজে প্রতি সাতজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক থাকলে তার মধ্য থেকে দুইজন প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপকের পদোন্নতি পান। বর্তমানে টি আলী কলেজে ২৩ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন। পদোন্নতির অনুপাত অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক রয়েছেন ছয়জন।
সে হিসেবে খালেদ আব্দুল্লাহ হাসানের আর পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। কলেজটিতে যদি নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় এবং তারা সাথে সাথে এমপিওভুক্ত হন তবু অনুপাত হিসেবে তার সম্ভাবনা নেই। কারণ তার আগে আরো কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক রয়েছেন যারা এখনো পদোন্নতি পাননি।
ওই কলেজের প্রভাষক খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, আমি গত ২৬ বছর ধরে লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা করছি এ কলেজে। ১৯৯২ সালে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি এবং আজ পর্যন্ত কোনো পদোন্নতি হয়নি আমার। যোগদানের সময়ই সহকারী অধ্যাপকের কোটা পূর্ণ ছিল। ফলে আমার আর আজ অবধি পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ হয়নি।
২০১৬ সালে তিনজন সহকারী অধ্যাপক অবসরে গেলেও আমার পদোন্নতি হয়নি। কারণ শূন্যপদে নতুন লেকচারার নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ হয়নি।
খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, আমার পর আরো কয়েকজন শিক্ষক যোগদান করেছেন এ কলেজে যাদের বয়স খুব শিগগিরই ৬০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে এবং তাদের আর সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সম্ভাবনা নেই।
খালেদ আব্দুল্লাহ হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস। তার মতো সারা দেশে প্রায় প্রতিটি এমপিওভুক্ত কলেজে কয়েকজন করে এমপিওভুক্ত লেকচারার রয়েছেন যারা কয়েক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন কিন্তু পদোন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই তাদের। এর কারণ পদোন্নতির বিষয়ে সরকারি নীতির সীমাবদ্ধতা। সারা জীবন অল্প বেতন আর এক পদে চাকরি করে পদোন্নতিবঞ্চিত অনেক শিক্ষক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আর হতাশায় দিন পার করছেন অনেকে। অনেকে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অথচ এসব শিক্ষকের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স পাস করা।
যেমন খোদেজা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস করা। তিনি বলেন, কলেজে যোগদানের তিন বছরের মাথায় একবার এবং আট বছরের মাথায় আরেকবার টাইম স্কেল বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর আর কোনো টাইম স্কেল বাড়েনি। বর্তমানে আমি ২৯ হাজার টাকা মূল বেতন পাই। এর সাথে এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা। আর গত বছর আন্দোলনের ফলে মূল বেতনের শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
লেকচারার হলেও একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে তিনি শিক্ষাবোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন এবং মাস্টার ট্রেনারের দায়িত্ব পালন করছেন। আফসোস করে বললেন, আমি যখন প্রশ্নপত্র মডারেশনের কাজে যাই তখন চারজনের যে কমিটি হয় সেখানে তিনজন থাকেন সরকারি কলেজের শিক্ষক। আমি যখন টিএডিএর জন্য সই করি সেখানে আমার মূল বেতন লিখতে হয়। আমার খুবই কম বেতন দেখে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। হতাশা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ছাত্রছাত্রীরাই আমার কত পরে বিভিন্ন কলেজে যোগ দিয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আজো লেকচারার।
টি আলী কলেজের আরেকজন শিক্ষক নাসরিন জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স পাস করে ১৯৯৪ সালে লেকচারার পদে যোগ দেন। আজ অবধি তিনিও লেকচারারই রয়ে গেছেন। যে কারনে খোদেজা ইয়াসমীনহ অনেকের পদোন্নতি হয়নি ঠিক একই কারণে পদোন্নতি হয়নি তারও।
বেসরকারি কলেজের একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক তার জীবনে সর্বোচ্চ সহকারী অধ্যাপক বা অ্যাসিট্যান্ট প্রফেসর হতে পারবেন। এর পর আর কোনো পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই সরকারের পক্ষ থেকে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ তে বলা হয়েছে, এইসএসসি পর্যায়ের কলেজে প্রতি বিষয়ে একজন এবং ডিগ্রি ও অনার্স পর্যায়ের কলেজে প্রতি বিষয়ে দুইজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এমপিওভুক্ত একজন প্রভাষক আট বছরের মাথায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন ৫ : ২ অনুপাতে। একজন শিক্ষক চাকরি জীবনে দুটির বেশি উচ্চতর গ্রেড বা টাইম স্কেল পাবেন না। নীতিমালায় সহকারী অধ্যাপকের পরে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে তাদের আর কোনো পদোন্নতির কথা বলা হয়নি।
বেসরকারি কলেজে প্রতি বিষয়ে এক থেকে দুইজনের বেশি শিক্ষককে এমপিওভুক্ত না করা, এমপিভুক্ত শিক্ষকদের সবাইকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না দেয়া এবং পরবর্তী আর কোনো পদোন্নতি না থাকাকে সরকার কর্তৃক জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলেন ক্ষুব্ধ একজন শিক্ষক। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বেসরকারি কলেজে অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা অধ্যাপক হওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাদের সহকারী অধ্যাপকের পরে আর কোনো পদোন্নতি দেয় না সরকার। এটা বেসরকারি শিক্ষখাতের প্রতি চরম বৈষম্য, অবহেলা আর উদাসীনতা সরকারের। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা মানেই হলো বেসরকারি খাতের শিক্ষা। তিনি বলেন, অনেক কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক শিক্ষককে সান্ত্বনাস্বরূপ সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়। কিন্তু আর্থিক সুবিধা দেয় না। অনেক কলেজে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষরা অভ্যন্তরীণভাবে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নেন কিন্তু এর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই।


আরো সংবাদ



premium cement