২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

৫০ আসনের ৩৩টিতে আগের রাতে সিল

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন ইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ : ইফতেখারুজ্জামান গণতন্ত্রের জন্য এই ধরনের নির্বাচন ইতিবাচক নয় : সুলতানা কামাল
-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। নির্বাচনী আংশিক অংশগ্রহণমূলক ছিল। এতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কার্যত ইসি সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তার আত্মীয়ের মনোনয়ন নিয়ে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে, ৩৩টিতে আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। টিআইবির চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, যেভাবে এবারের নির্বাচন পরিচালিত হয়েছে তাতে অনেক ত্রুটি ছিল। আর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন আংশিক অংশগ্রহণমূলক ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।
‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার টিআইবির ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০০টি আসনের মধ্য থেকে ৫০টি দ্বৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়। ওই ৫০টি আসনের ১০৭ জন প্রার্থীর ওপর জরিপ চালানো হয়। নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও কার্যকর করতে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে ছয় দফা সুপারিশ পেশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬টিতে বিরোধী দলের প্রচারে বাধা দেয়া হয়। ৪৪টি আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতাকর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে ভয়ভীতি দেখানোর তথ্য পাওয়া যায়।
৫০টি আসনের ৪৭টিতেই অনিয়ম : প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সার্বিকভাবে তফসিল ঘোষণার আগ থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫ টাকা, যা নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত ব্যয়সীমার (আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা) তিন গুণেরও বেশি। প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (গড়ে পাঁচ গুণের বেশি) এবং সবচেয়ে কম ব্যয় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
৪৭টি আসনে নির্বাচনের দিনেও কোনো না কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ৪১টি আসনে জাল ভোট, ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা, ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল, ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া এবং ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া ইত্যাদি। ১৮৬টি আসনে ভোট দেয়া হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ১৩টি আসনে ভোট ৯০ শতাংশের ওপরে; অন্য দিকে ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে তিনটি আসনে।
সরকারি দলের প্রচারণা : বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান বা স্পট সম্প্রচারের সুবিধা পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এতে খরচ হয়েছে ২০ কোটি ২ লাখ ৮৪ হাজার ৪৫ টাকা। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের দশটি বিষয়ে অনুষ্ঠান ২৭টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কেবল ডিসেম্বর মাসে মোট ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৪১ সেকেন্ড সময় ধরে প্রচারিত হয়। এর প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩০ টাকা। ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ নামে একটি টিভি স্পট অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ১৩টি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। যার প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭০ টাকা এবং ‘আমরা বাংলাদেশের পক্ষে’ নামে ৫৫টি টিভি স্পট ডিসেম্বর মাসে ২৫টি চ্যানেলে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৯৫ সেকেন্ড প্রচারিত হয়, যার প্রাক্কলিত আর্থিক মূল্য ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৪৫ টাকা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত সংবাদে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং বিরোধী দল বা জোটের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। জয়ী প্রার্থীর গড়ব্যয় এক কোটি ২৭ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭৭ টাকা। এর মধ্যে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা এবং আরেকজন প্রার্থী সর্বনিম্ন ২ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয় করেছেন।
ইসির ব্যর্থতা : গবেষণায় দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান নেয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘন বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ ইত্যাদি। ফলে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যেমনÑ পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মোবাইলের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা, জরুরি ব্যতীত মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ক্ষমতাসীনদের কার্যক্রমে নির্বাচন প্রভাবিত : গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোনো কোনো কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমনÑ সংসদ না ভেঙে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদনসহ নির্বাচনের প্রায় এক বছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা, বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া এবং সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখা হয়। পাশাপাশি বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে।
টিআইবির ৬ দফা সুপারিশ : সুপারিশে টিআইবি বলেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বহুমুখী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ব্যর্থতা নিরূপণ করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্তের উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, সাহসী ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষ হতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ ডিজিটালাইজ করতে হবে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহের জন্য অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এবারের নির্বাচনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসনের একাংশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে; যেটি আইনের লঙ্ঘন ও নীতিবিবর্জিত। সর্বোপরি আংশিকভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে। কারণ এক দিকে সব রাজনৈতিক দল প্রার্থিতার মাপকাঠি নির্বাচনে ছিল, কিন্তু নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয়তার বিবেচনায় বৈষম্য ছিল প্রকট। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পারেননি। আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অবশ্যই ব্যাপকভাবে লজ্জাজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ভূমিকাও ছিল বিতর্কিত। আর এসব কারণেই নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং বলা যায়, অভূতপূর্ব একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের ফলাফলও অনেকের কাছেই অবিশ^াস্য হিসেবে আলোচিত হয়েছে। তাই আমরা সরকারের নৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এবং সরকারের আত্মবিশ^াস বৃদ্ধির জন্য যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাই।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন এই ত্রুটিগুলো দেখে, তার সত্যাসত্য বিচার করে পরবর্তী যে নির্বাচনগুলো হবে সেগুলোতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয় সে চেষ্টাই করনে। কারণ আমরা দেখতে চাই, সত্যিকার অর্থেই জনগণের পছন্দের মানুষই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। তিনি বলেন, এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য এই উদাহরণ রেখে যাচ্ছে যে, যদি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ না থাকে তাহলে নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, বিতর্কিত হয়ে যায়। আর তখন একটা সংশয় থেকেই যায় যে, যারা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে গেলেন, তারা আমাদের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করবেন, জনগণের স্বার্থ কতখানি দেখবেন।


আরো সংবাদ



premium cement