২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাঠে নামলেই হামলার শিকার প্রার্থীরা

সব দায় নির্বাচন কমিশনের : ড. বদিউল আলম
-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও এখনো তৈরি হয়নি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। সৃষ্টি হয়নি নির্বাচনী পরিবেশ। সার্বিক পরিস্থিতিও সঙ্ঘাতপূর্ণ। বিএনপির প্রার্থী সমর্থকেরা প্রচারণায় নামলেই হামলার শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির শীর্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হামলা হয়েছে প্রকাশ্যে। ধানের শীষের পোস্টার লাগাতে গেলেই বাধা দিচ্ছে সরকারি দলের লোকজন। প্রচারণার মাইক কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এখনো ধরপাকড় বন্ধ হয়নি। নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন এবং ধরপাকড় বন্ধের জন্য নির্বাচন কমিশনে একাধিকবার আবেদনের পরও প্রতিকার পাচ্ছে না বিরোধী দলগুলো। এ ব্যাপারে পুলিশের প্রধান আইজিপির সাথেও বৈঠক করেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু ধরপাকড় বন্ধে তারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে বিএনপির দাবি। বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর কর্মীদের বাধা-বিপত্তি, হামলার ঘটনা ঘটছে। এতে করে দ্বিমুখী আতঙ্ক ও ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। সময় যতই গড়াচ্ছে দেশজুড়ে নির্বাচনী সহিংসতায় উদ্বেগ ততই ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা এই সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো এলাকায় পুলিশের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এমনিতেই পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের বিএনপির অভিযোগ মারাত্মক। গাজীপুরে ধানের শীষের প্রার্থী ফজলুল হক মিলন, সাতক্ষীরায় গাজী নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নেত্রকোনা-২ আসনের প্রার্থী ডা: আনোয়ারুল হকের নির্বাচনী প্রচার ও তার বাসা এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে নানামুখী তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিবিদ, ভোটার ও সাধারণ মানুষের মাঝে শঙ্কা ও ভয়ভীতিও বাসা বাঁধছে। ভোট হবে কি না এই অনিশ্চয়তা জোরালো হচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা ও সহিংসতার বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচনী প্রচারণায় সহিংসতা-সংঘর্ষে প্রমাণিত হয় নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। অথচ নির্বাচনের আগে পরিবেশ তৈরির কাজ নির্বাচন কমিশনের। এখন যা হচ্ছে তার দায় নির্বাচন কমিশনের। কারণ বল তাদের কোর্টে। তারাই এখন রেফারি। তাদেরই হুঁইসেল বাজাতে হবে। এসব হামলা-সঙ্ঘর্ষ সামলাতে না পারলে পরিস্থিতি জটিল হবে।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গুলি, বোমা, হামলা, ভাঙচুর, মারধরসহ অসংখ্য ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। সাধারণ মানুষ এসব পছন্দ করছেন না। তাদের প্রত্যাশা, ভোটের ময়দান হবে সমতল, সমান সুযোগের এবং স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করবে। সবাই চায় সঙ্ঘাতমুক্ত একটা নির্বাচন। কিন্তু বর্তমান প্রচারণার মাঠ একতরফা। বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা প্রচারণায় নামলেই হামলা-গ্রেফতারের শিকার হচ্ছেন। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ড. কামাল হোসেন, ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়ি বহরে হামলা হয়েছে। বিজয় দিবসের দিন (রোববার) নরসিংদীর পাঁচদোনায় ধানের শীষের প্রার্থী ড. আব্দুল মঈন খানের নির্বাচনী মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করে মঈন খান ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের অবরুদ্ধ করে রাখে এবং হামলায় ৫০ থেকে ৫৫ জন কর্মী আহত হন। একই দিনে চট্টগ্রামে ধানের শীষের প্রার্থী বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের নির্বাচনী প্রচার মিছিলে হামলা হয়। প্রাণে বেঁচে যান নোমান। শনিবার নোয়াখালীতে বিএনপির প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গুলিবিদ্ধ হন। বিএনপির অভিযোগÑ সরকারি দলের লোকজনের সাথে সংঘর্ষকালে পুলিশের ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি। গত শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) সিরাজগঞ্জে পুলিশের গুলিতে বিএনপি প্রার্থী রুমানা মাহমুদসহ আহত হন ২০ কর্মী। মেরিনা নামের এক কর্মীর দুই চোখে স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়েছেন। এই দিন ঢাকা-৬ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী সুব্রত চৌধুরীর ওপর ঢাকার হাটখোলা মোড়ে হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী। সেই সময় যুবদলের বুলবুলসহ পাঁচ কর্মী আহত হন। পুলিশ বুলবুলকে বিনা উসকানিতে গ্রেফতারও করে। পটুয়াখালী-৩ আসনের প্রার্থী গোলাম মাওলা রনির স্ত্রী ওপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী। গতকাল পটুয়াখালীর বাসায় রনিসহ তার পরিবারের লোকদের অবরুদ্ধ করে রাখে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
নাটোরের বেশির ভাগ এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে গেলে হামলার শিকার হতে হচ্ছে। পোস্টার ব্যানার টাঙাতে বাধা দেয়া হচ্ছে। নাটোর সদর আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন ছবির প্রচারণার অটোরিক্সা ও মাইক ভাঙচুর করা হয়। এ আসনে বিএনপির নেতাকর্মীদের হাতুড়িপেটা করা হয়। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে সহিংসতা, যা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। যশোর-খুলনা অঞ্চলের অধিকাশ নির্বাচনী আসনেই একতরফা হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। যশোরে ধানের শীষের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলামকে হত্যা প্রচেষ্টা, তার পথসভার কাছে বোমা হামলা করে ত্রাস সৃষ্টি, নির্বাচনী কার্যালয়, প্রচার মাইক ভাঙচুর ও পোস্টার ছিঁড়ে পোড়ানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগÑ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর ঐক্যফ্রন্টের সারা দেশে ৩০০ আসনের প্রার্থীরা ধানের শীষের নির্বাচনী প্রচারে নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। পুলিশ ধানের শীষের প্রার্থীদের বাধা দিচ্ছে, পুলিশ কর্মকর্তারা প্রার্থী, কর্মী ও সমর্থকদের শাসাচ্ছে। সরকারি দলের সন্ত্রাসী বাহিনী থগুলি করছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে, গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখানে হচ্ছে, নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করা হচ্ছে এবং প্রচারের মাইক ভাঙচুর ও জব্দ করা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বন্ধের পথ খুঁজছে ক্ষমতাসীনেরা। ইতোমধ্যে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের গাড়িবহরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের আঙ্গিনায় আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডারবাহিনী হামলা করলেও প্রশাসন সম্পূর্ণ নিশ্চুপ এবং কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে প্রতীয়মাণ হয় যে, সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তরিক নয়। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আজকের (১৮ ডিসেম্বর) মধ্যে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর দাবি জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে ধানের শীষের প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালাচ্ছে। তারা পরাজয়ের ভয়ে নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপির নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বাধা ও নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের এসব নিপীড়ন-নির্যাতন ও অত্যাচারে সারা দেশে নির্বাচনী সুষ্ঠু পরিবেশ বলতে কিছু নেই। তিনি বলেন, দলীয় সন্ত্রাসী আর পেটোয়া বাহিনী দিয়ে সাধারণ জনগণকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সময় এখন জনগণের। আমরা নিশ্চিত, এবার সব বাধা অতিক্রম করে সারা দেশে সাহসী জনতা ধানের শীষের বিজয় ছিনিয়ে আনবেই ইনশা আল্লাহ।

 


আরো সংবাদ



premium cement