শরিকদের নিয়ে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ

কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ১৪ দলের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এবার তাকে ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন বোর্ডের অন্যতম সদস্য মো: রশিদুল আলম নৌকার মনোনয়ন পেতে দলীয় ফরম কিনেছেন। তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বড় ভাই। কয়েক মাস ধরে কুষ্টিয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা জাসদের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকে নৌকা প্রতীক দিতে এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন। এমনকি তারা জাসদকে স্থানীয়ভাবে বয়কটেরও ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের শরিক এ দলটির সাথে সংঘর্ষে একাধিক নেতাকর্মী হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এবার সাবেক আমলা রশিদুল আলমের পক্ষে শুধু ওই আসনই নয়, পুরো জেলার নেতাকর্মীরা একাট্টা বলে দাবি করেছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা।

ঢাকা-৮ (রমনা-মতিঝিল-পল্টন) আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি ইতোমধ্যে ওই এলাকায় একাধিকবার বিশাল শোডাউন করেছেন। শেষ পর্যন্ত দল তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তিনি আশাবাদী। এ ছাড়া যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা মো: আবু কাউছার এবং মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারসহ আরো কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এ আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তারা এবার রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেখতে চান।

নোয়াখালী-৪ আসনে এবার মনোনয়ন চান সরকারের সম্ভাব্য শরিক ও বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব:) আব্দুল মান্নান। বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে জানা গেছে। এই খবরে ুব্ধ ওই আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক সিনিয়র নেতা চান আমি যাতে আর রাজনীতি না করি।’
এ দিকে মেজর মান্নানকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনও ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে দলে গুঞ্জন রয়েছে। ওই আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী এবং বর্তমান এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ দলের আরো ডজনখানেক নেতা মনোনয়ন চান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব আসনে জোটের শরিকদের ছাড় দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার প্রায় সব খানেই মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কয়েক শ’ মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা। জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কোনোভাবেই শরিকদের ছাড় দিতে রাজি নন। এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেসব আসন শরিকদের ছাড় দেয়া হয়েছিল সেসব আসনও এবার নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। দল থেকে মনোনয়ন দেয়া না হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেবেন বলে জানান দিয়েছেন অনেকে। বিষয়টি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, এবার আওয়ামী লীগের কাছে জোটের শরিকরা কমপক্ষে ১০০ আসন চায়। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি ৭০টি, জাসদ ২০টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১০টি আসন দাবি করছে। তবে জোটের শরিকদের সব মিলিয়ে ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫টি আসন ছাড় দেয়ার কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকবার এমন আভাস দিয়েছেন। আর দল বা জোটের প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহ করলে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কেন্দ্রীয় স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেসব আসন শরিকদের ছাড় দেয়া হয়েছিল সেসব আসনে এবার গড়ে আওয়ামী লীগেরই ১০-১৫ জন করে নেতা প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ নিয়ে অনেক আসনেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে মহাজোটের এমপি এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সমর্থকের মধ্যে। জোটের বর্তমান এমপিদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রে নানা অভিযোগও জমা পড়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের। এ পরিস্থিতিতে সেখানে জোট শরিকদের ছাড় দেয়া হলে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরাও বেশ অস্বস্তিতে রয়েছেন।

গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে তিনটিতে জাতীয় পাটির প্রার্থী জয়ী হন। আর সারা দেশের মতো রাজধানীতেও তাদের সাথে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরোধ চলছে। এর মধ্যে ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) আসনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার বিপক্ষে মনোনয়ন চান সংরতি মহিলা এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সহকারী সচিব ড. আওলাদ হোসেনসহ ডজন খানেক নেতা।

লক্ষ্মীপুর-২ আসনে গত নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় পার্টি থেকে মোহাম্মদ নোমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এবারো মহাজোটের প্রার্থী হতে চান। সেখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দলের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আলহাজ হারুনুর রশিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন, কুয়েত প্রবাসী ব্যবসায়ী সহিদ ইসলাম পাপুল, বিএমএ নেতা ও অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা: এহসানুল হক জগলুল, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো: আলী খোকন, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামসুল ইসলাম পাটোয়ারী, জেলা যুবলীগ সভাপতি সারাউদ্দিন টিপুসহ ১৬ জন।
লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব লায়ন এম এ আউয়াল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারের এ শরিক দলকে দেয়া দু’টি আসনের মধ্যে এটি একটি। এবারো জোটের প্রার্থী হতে চান তিনি। তবে তার এ চাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও শিল্পপতি আনোয়ার খান। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এম এ আউয়াল যাতে এবার আর জোটের মনোনয়ন না পান সেজন্য তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব পদ থেকে কৌশলে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে পথের কাঁটা দূর করতে তরিকতের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সাথে আনোয়ার খানের মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। এ ছাড়া এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সফিকুল ইসলাম, উপজেলা সভাপতি সফিক মাহমুদ পিন্টু, সাবেক কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম এ মমিন পাটোয়ারী এবং উপজেলা সহসভাপতি শামসুল হক মিজানসহ অনেকে।

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে গতবার জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকা মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। তবে এবার তাকে ছাড় দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এ এইচ এম মাসুদ দুলাল। এ ছাড়া সাবেক এমপি কায়সার হাসনাতসহ ডজনখানেক নেতা সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান।
ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামের বিপক্ষে তৎপর রয়েছেন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা। তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মান্নান খান, ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের বেয়াই আবদুল বাতেনসহ অনেকে।
অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও মহানগরীগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম-৫ আসনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সিলেট ২ ও ৫ আসনে ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী ও সেলিম উদ্দিন, রংপুর ১ আসনে মসিউর রহমান রাঙ্গা, কুমিল্লা ২ ও ৮ আসনে মোহাম্মদ আমির হোসেন ও নুরুল ইসলাম মিলন, বরিশাল-৬ আসনে নাসরিন জাহান রতœা, কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে মজিবুল হক চুন্নুর আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা দলের মনোনয়ন চান।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, এবারের নির্বাচনী সমীকরণ খুব জটিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার কপাল খুলতে পারে আবার অনেকের কপাল পুড়তে পারে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা স্পষ্ট হবে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান বলেন, প্রত্যেক আসনে আওয়ামী লীগের ১০ থেকে ১৫ জন যোগ্যপ্রার্থী রয়েছেন। তবে জোটের বৃহত্তর স্বার্থে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের বিষয়টি মেনে নিতে হবে।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগে ত্যাগী ও যোগ্য নেতার অভাব নেই। প্রায় প্রত্যেকটি আসনেই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় একাধিক নেতা রয়েছেন। তবুও সমমনা বিভিন্ন দলের সাথে আওয়ামী লীগ যেহেতু নির্বাচনী জোট করেছে সেহেতু জোটের স্বার্থকে সবার প্রাধান্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত নেতারা অবশ্যই দলের বিভিন্নপর্যায়ে মূল্যায়িত হবেন।