১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নয়াপল্টন রণক্ষেত্র

পুলিশের গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর বহু আহত; অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার
নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ : নয়া দিগন্ত -

শোডাউন বন্ধে নির্বাচন কমিশনের চিঠির এক দিন পরই পাল্টে গেল উৎসবমুখর নয়াপল্টনের দৃশ্য। বেলা তখন ১টা। নেতাকর্মীতে ঠাসা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের একের পর এক মিছিল আসছে। হঠাৎ কিছু পুলিশ সদস্য রাস্তা থেকে নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিতে উদ্যোগী হলে গণ্ডগোলের সূত্রপাত হয়। নেতাকর্মীদের সাথে কয়েক মিনিটের বাগি¦তণ্ডার একপর্যায়ে পুলিশ যথারীতি লাঠিচার্জ শুরু করে। বেধে যায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। ফকিরাপুল থেকে নাইটিঙ্গেল মোড় পুরো সড়কে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট আর ছররা গুলি চালায় পুলিশ। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় হেলমেট পরা একটি দলকে পুলিশের দু’টি গাড়ি ভাঙচুরের পর অগ্নিসংযোগ করতে দেখা যায়। পরিস্থিতি আঁচ করে পুলিশ কিছুটা দূরে সরে গেলে ঘণ্টাব্যাপী উত্তপ্ত পরিস্থিতির অবসান হয়। তবে এ ঘটনার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরো নয়াপল্টন সড়কের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত নেতাকর্মীরা মুহুর্মুহু সেøাগানে প্রকম্পিত করে রাখেন।
সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রদলসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীকে ছররা গুলির আঘাতে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে তখন রক্ত ঝরছিল। আহতদের তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিএনপি অভিযোগ করেছে পুলিশের গুলি ও লাঠিচার্জে অর্ধশত কর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ দাবি করেছে, তাদেরও সাত-আটজন সদস্য আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় ৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমাদান কার্যক্রম।
এ দিকে ঘটনার পরপর পুলিশ কাউকে গ্রেফতার না করলেও সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর বিএনপি অফিস থেকে যারা বেরিয়েছে তাদের প্রায় সবাইকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
জানা গেছে এ সময় বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর গত সোমবার থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হয়। এতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দৃশ্য পাল্টে যায়। নেতাকর্মীদের উপস্থিতি জনসমুদ্রে রূপ নেয়। গতকাল বুধবার ছিল মনোনয়ন ফরম বিক্রির তৃতীয় দিন। সকাল থেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নেতাকর্মী-সমর্থকদের সাথে নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে থাকেন। তবে আগের দুই দিনের চেয়ে গতকাল সকাল থেকেই পুলিশের তৎপরতা ছিল ভিন্ন রকম। নেতাকর্মীদের জমায়েতে তারা বিচ্ছিন্নভাবে বাধা দেয়ারও চেষ্টা করে। দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে একটি মিছিল কার্যালয়ের সামনে আসে। এ সময় বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের আরো কয়েকটি মিছিল দলীয় কার্যালয়ের সামনে এসে জড়ো হয়। একপর্যায়ে কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন এবং তাদের ফুটপাথের দিকে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
নেতাকর্মীরা এতে বাদ সাধলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশের প থেকে এ সময় দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। তখন উপস্থিত নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছোড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নয়াপল্টন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। প্রথম দিকে নেতাকর্মীরা আশপাশের অলিগলির ভেতরে ঢুকে গেলেও পরে তারা এক সাথে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল, জুতা এবং বিভিন্ন বস্তু নিপে করেন তারা। এ সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়। এরপর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে একদল পুলিশ ভাসানী গলিতে, আরেক দল বিজয়নগরের দিকে সরে যায়। ফলে পুরো সড়ক চলে যায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। কোনো কোনো নেতাকর্মীকে খালি গায়ে রাস্তায় বসে ‘পারলে গুলি করো’ বলতে শোনা যায়। এ সময় হেলমেট পরা একটি দল মিডিয়ার গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স বের করে দিয়ে কয়েকটি মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ভাঙচুর করে। পুলিশের একটি পিকআপ এবং একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হেলমেট পরিহিতরা বিএনপির নেতাকর্মী কি না তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
পুলিশ থামলে নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে স্কাউট ভবন পর্যন্ত মুহুর্মুহু মিছিল করে। বেলা ২টার পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে যুবদল-ছাত্রদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা ‘বিএনপি অফিসে গুলি কেন, শেখ হাসিনা জবাব দে’, ‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো’ এ ধরনের নানা সেøাগান সন্ধ্যা পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড মিছিল অব্যাহত রাখে।
পুলিশের সাথে দলের নেতাকর্মীদের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির একপর্যায়ে কার্যালয়ের ভেতরে থাকা দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিচে নেমে এসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বরাত দিয়ে নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে ফুটপাথে অবস্থান গ্রহণ করার অনুরোধ করেন।
পুলিশ বিনা উসকানিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর গুলি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সকাল থেকে নেতাকর্মীরা কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছিলেন। দুপুরে পুলিশ বিনা উসকানিতে হামলা চালায়। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আমি পুলিশকে অনুরোধ করব, শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এবং গণতন্ত্র ধ্বংস হয়, এমন কাজ করবেন না। কারো নির্দেশে কাজ করবেন না। আপনারা দেশের সন্তান। কারো স্বার্থ রার্থে অন্যায় নির্দেশ পালন করবেন না।
রিজভী বলেন, আমরা গত দুই দিন শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছিলাম। আজকে বিনা উসকানিতে হামলা করা হয়েছে। হামলাকালে আমাদের আব্বাস, নাহিদ, মুকুল, মোস্তফা, স্বপন, হারুনসহ ২০ জনের মতো নেতাকর্মী পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন।
সংঘর্ষের পর কার্যালয়ের সামনে বিএনপির একটি চিকিৎসক দলকে আহতদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালেও পাঠানো হয়। গুলিতে আহত মহানগর উত্তর ছাত্রদলের নেতা তানভীর আহমেদ খান ইকরাম জানান, পুলিশের ছররা গুলিতে বহু নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। কারো চোখে, কারো পেটে, কারো মাথায় গুলি লেগেছে।
পুলিশের প থেকে দাবি করা হয়েছে, বিনা উসকানিতে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল। হঠাৎ বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। প্রাথমিকভাবে আমাদের ৮-১০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। আহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।
পরে বিকেল সাড়ে ৪টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন দলীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের ওপর গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের ঘটনা পরিকল্পিত। এই সরকার আবারো ভোটার শূন্য একটি নির্বাচন করতে চায়। আর সরকারের সব দুষ্কর্মের দায়িত্ব নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
তিনি বলেন, আমরা বিগত এক দশক ধরে সরকারের নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে আসছি। অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে এবং ন্যায়ের পক্ষে আন্দোলন করে আসছি। এই সরকার তো সভ্যতার সব বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। আমরা আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রিজভী বলেন, গত তিন দিনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতাকর্মীদের ঢল দেখে সরকারের হৃদকম্প শুরু হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়ায় হঠাৎ করেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আসলে এই সরকার মানুষের ঢল সহ্য করতে পারে না। হামলার জন্য নির্বাচন কমিশন ও সচিব দায়ী। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় পুলিশ বিনা উসকানিতে আক্রমণ করেছে।
রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বিক্রির সময়তো চার-পাঁচ দিন ধানমন্ডি ও আশপাশের রাস্তা বন্ধ ছিল তখন তো ইসি কোনো নির্দেশনা জারি করেনি। আওয়ামী লীগে নিজেদের সংঘর্ষে দুইজন মারাও গেছেন। তিনি বলেন, নয়াপল্টনে হেলমেট পরে কারা হামলা চালিয়েছে? গাড়িতে কারা আগুন দিয়েছে? এরা সরকারের এজেন্ট।


আরো সংবাদ



premium cement