২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে এরশাদ

নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছি

জাতীয় জোটের মহাসমাবেশে বক্তৃতা করছেন এইচ এম এরশাদ : নয়া দিগন্ত -

সুশাসনের লক্ষ্যে ও জাতির মুক্তির পথে ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, এটা হলো মুক্তির পথ, দেশের মুক্তির পথ, জাতির মুক্তির পথ। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আমার জীবনটা উৎসর্গ করতে চাই। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, আমরা আজো জোটবদ্ধভাবে ৩০০ আসনেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে এরশাদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের সংশয় আছে। আমিও শঙ্কায় আছি, নির্বাচন হবে কী হবে না জানি না। একটি দল সাত দফা দিয়েছে, সরকার মানতে চায় না। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তা মানা সম্ভবও নয়। আমরা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। এর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মিলিত জাতীয় জোটের মহাসমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ এ দাবি জানান। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া এ মহাসমাবেশ মঞ্চে এরশাদের পাশে ছিলেন পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের, পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপিসহ প্রেসিডিয়াম সদস্যরা এবং জোটের শরিক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাতীয় ইসলামী মহাজোটের শীর্ষনেতারা। সমাবেশে আরো বক্তৃতা করেন ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মান্নান, খেলাফত মজলিসের মাওলানা মাহফুজুল হক, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, এস এম ফয়সল চিশতী, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি, বিরোধী দলের চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর এমপি, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, রুস্তুম আলী ফরাজী এমপি, ইসলামী ফ্রন্টের আল্লামা আবু সুফিয়ান, বিএনএ’র সেকান্দার আলী মনি, জাতীয় ইসলামী মহাজোটের আলহাজ আবু নাছের ওহেদ ফারুক প্রমুখ।
সমাবেশে প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, এম এ সাত্তার, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি, মো: আবুল কাশেম, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রতনা এমপি, মেজর (অব:) খালেদ আখতার, ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, অধ্যক্ষ রওশন আরা মান্নান এমপি, রিন্টু আনোয়ার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কারি হাবিবুল্লাহ বেলালী, মেরিনা রহমান এমপি, সৈয়দ দিদার বখত, সেলিম উদ্দিন এমপি, জিয়াউল হক মৃধা এমপি, মাহজাবিন মোর্শেদ এমপি, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ এমপি, শওকত চৌধুরী এমপি, শাহানারা বেগম এমপি, মামুনুর রশীদ এমপি, পীর ফজলুর রহমান মেজবাহ এমপি, আমির হোসেন ভূঁইয়া এমপি, আকরাম আলী এমপি, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, ইয়াহইয়া চৌধুরী এমপি, সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি এমপি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের ‘শক্তিমত্তার’ জানান দিতে সোহরাওয়ার্দীতে এরশাদ নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের এ মহাসমাবেশের আয়োজন। নির্বাচনের আগমুহূর্তে জাতীয় পার্টির এ মহাসমাবেশ কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য জানান দেয় দলটি। খুব সকালে সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান নেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে মিছিলের চাপ। নানা রঙ-বেরঙের ব্যানার, ফেস্টুন, আর নানা সাইজের লাঙল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করেন পার্টির উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা। বাদ্যের তালে তালে তালে নেচে-গেয়ে তরুণেরা উৎসবমুখর করে তোলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যত মানুষ ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল মঞ্চের পেছনে এবং মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত। সারা দেশ থেকে মহাসমাবেশে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মীর সামনে আবেগাপ্লুত হয়ে এরশাদ বলেন, আগামী নির্বাচন হয়তো হবে আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আমার জীবনটা উৎসর্গ করতে চাই। ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার ২৭ বছরে নানা নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নির্যাতিত রাজনীতিবিদ আমি, কোনো নেতা আমার মতো নির্যাতন সহ্য করেনি। ’৯০ সালের পরে একটি রাতও আতঙ্কে ঘুমাতে পারিনি। আতঙ্ক ছিল কখন আবার জেলে যেতে হয়। আমি দেশের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এটাই আমার জীবনের শেষ নির্বাচন। আমার জীবন দেশ ও জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম।
এরশাদ ১৮ দফায় প্রাদেশিক সরকার গঠন করে প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনপদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও পুনর্গঠন এবং সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এরশাদ বলেন, আমরা ক্ষমতায় এসে প্রাদেশিক সরকার করতে চাই। আমরা প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করতে চাই। আমরা পূর্ণাঙ্গ উপজেলা পরিষদ গঠন করতে চাই। আমি নতুনভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন করেছি এটাই হবে মুক্তির পথ। এটাই হবে আমাদের ইশতেহার, প্রাদেশিক সরকার গঠন করব, নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তন করব, পূর্ণাঙ্গ উপজেলা প্রতিষ্ঠা করব, সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণ করব, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করব, ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করব, কৃষকের কল্যাণ সাধনে কাজ করব, সন্ত্রাস দমনে কঠোর ব্যবস্থা করব, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে কার্যকর ব্যবস্থা নেবো, ফসলি জমি নষ্ট না হয় সে ব্যবস্থা করব, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করব, শিক্ষাপদ্ধতির সংশোধন করব, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করব, শান্তি ও সহাবস্থানের রাজনীতি প্রবর্তন করব, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করব, গুচ্ছগ্রাম পথকলি ট্রাস্ট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব, পল্লী রেশনিং চালু করব, শিল্প ও অর্থনীতির অগ্রগতি সাধন করব।
’৯০-এর পর অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচন ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হয়েছে মন্তব্য করে এরশাদ আবার ক্ষমতায় গেলে নির্বাচনপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি ও মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে দলের আসন বণ্টনের পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা বলেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি ও সম্মিলিত জাতীয় জোট ক্ষমতায় গেলে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধকে’ প্রাধান্য দেয়া হবে। তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থসংরক্ষণে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হবে। বিচার বিভাগের ‘স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
এরশাদ ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়া এবং জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, জোটগতভাবে নির্বাচন করব। আমরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবো। তবে দেশের স্বার্থে সেই সিদ্ধান্ত বদল হতে পারে। এ জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টিই আবার ক্ষমতায় আসবে।
এরশাদ বলেন, এ মাসের মধ্যে আমরা পার্লামেন্ট বোর্ড গঠন করব। আমরা জোটগতভাবে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করব। হয়তো তা পরিবর্তন হতে পারে। সে জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
এরশাদ বলেন, দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। সময়ের দাবি মেনেই আমরা পথ চলব। নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এরশাদ বলেন, জেলায় ফিরে গিয়ে প্রার্থী বাছাই করতে হবে। যারা আগ্রহী তাদের দলীয় আবেদন সংগ্রহ করতে হবে। এ মাসের মধ্যেই পার্লামেন্টারি বোর্ড ঘোষণা করব। তৃণমূলের সুপারিশ নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করব। ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করে জেলা কমিটির মাধ্যমে আমার কাছে জমা দিতে হবে। জোটের শরিকরাও তাদের প্রার্থী তালিকা জমা দেবে। দলের পরিচয়ের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা বেশি বিবেচনা করা হবে। তবে শেষ কথা হচ্ছে নির্বাচনের জন্য অবশ্যই সরকারকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
রওশন এরশাদ বলেন, দেশ আজ মাদক আর সন্ত্রাসে ছেয়ে গেছে। এ থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দিতে হলে জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, এরশাদ শাসনামল ছিল উন্নয়নের স্বর্ণযুগ। সে সময় ছিল না সন্ত্রাস, খুন-গুম ও জঙ্গিবাদ। মানুষের মধ্যে উপলব্ধি হয়েছে, দেশের উন্নয়ন ও শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে এরশাদের বিকল্প নেই। কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, দেশের মানুষ এবার এরশাদকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখতে চায়। মানুষ মনে করে এরশাদের শাসনামলে তারা সুখে থাকবে। শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। মায়ের কোলে সন্তান নিরাপদে থাকবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement