১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সংলাপ চান কূটনীতিকরা

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বেড়েছে দৌড়ঝাঁপ; চাপ বাড়ছে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের; ভারতের কট্টর মনোভাবে পরিবর্তন; যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট
-

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একটি ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় আসন্ন নির্বাচন নিয়েও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কূটনীতিক মহল। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী দলগুলোর বিভিন্ন দাবি সরকার না মানায় কিংবা আলোচনা ও সমঝোতার উদ্যোগ দৃশ্যমান না থাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগীরা নিজেদের গণ্ডির ভেতরে থেকেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুই দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। বসে নেই ইউরোপীয় ইউনিয়নও। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সাথে তারা মতবিনিময় করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করতে চায় তারা। কূটনীতিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবও বোঝার চেষ্টা করছেন। প্রায় প্রতিদিনই আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন ও চলমান রাজনৈতিক গতিবিধির ওপর সূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছে প্রভাবশালী দেশগুলো। সবার চাওয়া সুষ্ঠু নির্বাচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিরসনে কার্যকর সংলাপ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে কূটনীতিকদের দূতিয়ালি কিংবা দৌড়ঝাঁপ নতুন কিছু নয়। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এ দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই মূলত তারা সেই স্পেসটা পেয়ে থাকে। আগামী নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন স্তরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনকে শীর্ষ নেতৃত্বে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দাবি-দাওয়া আদায় ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কলাকৌশল আঁটছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া তফসিল ঘোষণা করা হলে ফ্রন্টের নেতৃত্বে স্বল্পকালীন বড় ধরনের আন্দোলনও গড়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক সেই পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা অনেককেই ভাবনায় ফেলেছে। যদিও সরকার প্রকাশ্যে কোনো কিছুই আমলে না নেয়ার কথাই বলছে। তবে তাদের অভ্যন্তরে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, এমন আঁচ করেই কূটনীতিকরা মতাসীন দলসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করে চলেছেন। নির্বাচন কমিশনেও সভা করছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে শাসক দলের উদ্যোগ কোন পর্যায়ে আছে, মাঠের বিরোধী দলই বা কী করছে সে বিষয়ে ধারণা নিতেই তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরকারবিরোধী জোটগুলোর তৎপরতার ওপর তারা নজর রাখছেন। বড় রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও সুশীলসমাজের সাথেও তারা বৈঠক করছেন। অনেক দিন ধরেই এ ধরনের তৎপরতা চলছে। তবে এত দিন বিষয়গুলো নিয়ে রাখঢাক থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় এখন ক্রমেই সব কিছু প্রকাশ্যে চলে আসছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সবাই চেষ্টা চালাচ্ছেন। এতে বড় দুই দলকে যদি কিছুটা ছাড়ও দিতে হয় সে বিষয়ে তাদের সম্মতি আদায় করাই এখন কূটনীতিকদের প্রধান ল্য বলে জানা গেছে।
গত সপ্তাহে প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা নির্বাচনসহ সমসাময়িক ইস্যুতে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ও ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আওয়ামী লীগের সাধারাণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে সাাৎ করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সাাৎ করেছে নির্বাচন কমিশনের সাথে। নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ প্রায় ৩০টি দেশের কূটনীতিকরা।
ওবায়দুল কাদেরের সাথে বৈঠকের পর বার্নিকাট আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আবারো পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, তারা চান একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হতে পারে।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ‘কট্টর’ নয়, যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দেখা গিয়েছিল। ওই নির্বাচনের আগে ভারত অনেকটা প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী- আওয়ামী লীগের সাথে ঐতিহাসিক মিত্রতার কারণে ভারত চায় আওয়ামী লীগই ফের ক্ষমতায় আসুক। তবে তাদের এই চাওয়াটা ‘নির্ধারণমূলক’ নয়। তারা চায় আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোক। যদি সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো পরিবর্তন আসে, তাহলে সে পরিবর্তনকেই স্বাগত জানাবে প্রতিবেশী দেশটি।
কূটনৈতিক তৎপরতার সাথে যুক্ত একজন রাজনীতিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, ভারত পপাতমূলক কিংবা নাক গলানোর মতো কোনো সরাসরি ভূমিকা এবার পালন করতে চায় না। নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে, এটাই গণতান্ত্রিক একটি দেশ হিসেবে তারা প্রত্যাশা করে।
কূটনীতিকরা গত বৃহস্পতিবার যুক্তফ্রন্টের নেতাদের সাথে যে বৈঠক করেছেন সেটিকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই বৈঠকে কূটনীতিকরা যে ধরনের মনোভাব দেখিয়েছেন, তাতে আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে যে সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা কাজ করছে তার কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে কূটনীতিকরা যুক্তফ্রন্টের নেতাদের ৮টি প্রশ্ন করেছেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। সব প্রশ্নের উত্তর গণফোরামের সভাপতি যেভাবে উত্তর দিয়েছেন, তাতে তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রমাণ হয়েছে বলে উপস্থিত অনেকের অভিমত।
বৈঠকে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রতিনিধির প্রশ্ন ছিল যুক্তফ্রন্ট নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। এর উত্তরে ড. কামাল বলেছেন- সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নেও ড. কামালের উত্তর ছিল বেশ গোছালো। তিনি বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন তারা।
জানা গেছে, কূটনীতিকদের সাথে এই বৈঠকের পর যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বের প্রতি দলগুলোর অভ্যন্তরে আস্থা বেড়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement