২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ গণমাধ্যম অঙ্গনে

-

সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে গণমাধ্যম অঙ্গনে। একই সাথে বিরাজ করছে আতঙ্ক আর উদ্বেগ। উদ্বেগ বিরাজ করছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিণতি নিয়ে। এ আইন পাসের ফলে শুধু যে স্বাধীন সাংবাদিকতা বিপন্ন হবে তা নয়, বরং সরাসরি সাংবাদিকদের নিপীড়নের মুখে পড়তে হবে বলে আতঙ্কিত অনেকে। নানা কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অঙ্গনে অনেক দিন ধরে সেলফ সেন্সরশিপ অবস্থা বিরাজ করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা আরো বাড়তে শুরু করেছে। তাই সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ এবং এ অঙ্গনে নিয়োজিত পেশাদারদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে সোচ্চার হচ্ছেন সাংবাদিকেরা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে শুধু যে সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়েছে তা নয়, বরং এ আইনকে সার্বিকভাবে গণতন্ত্র, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংবিধানবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকে একে একটি কালাকানুন হিসেবে আখ্যায়িত করে এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সাংবাদিক সমাজ এ আইন মানতে পারে না, মানা সম্ভব নয়।
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, তারা এ আইন সংশোধন বিষয়ে যেসব আপত্তি ও পরামর্শ তুলে ধরেছিলেন তা পাস করার আইনে প্রতিফলিত হয়নি। গণমাধ্যম অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক বিরাজ করছে আইনের ৩২ ধারা নিয়ে যেখানে বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এ জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি একটি কালাকানুন। এটি মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংবিধানবিরোধী। এ আইনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চা, গণতন্ত্র আরো সঙ্কুচিত হবে। সরকার তার সমালোচকদের এ আইনের মাধ্যমে দমন করতে পারবে।
দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, এ আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। পুলিশকে একচেটিয়া অধিকার দেয়া হয়েছে আইনের অপব্যবহার বিষয়ে।
তিনি বলেন, এ আইনের সবচেয়ে সর্বনাশা ধারা হলো ৪৩ ধারা। সেখানে একজন এসআইকেও গ্রেফতারের অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে । এমনকি বলা হয়েছে এটা তার মনে করা বা ইচ্ছার বিষয়। এ আইন সংবিধানেরও বিরোধী।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আইনের দরকার নেই তা আমরা বলছি না। কিন্তু মানুষকে কথা বলতে না দিলে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ তো আর ডিজিটাল থাকবে না, অ্যানালগ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী নয়া দিগন্তকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটা একই সাথে তথ্য অধিকার ও সংবিধানবিরোধী। কোনো সভ্যসমাজে এ আইন চলতে পারে না। মতপ্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ন্যূনতম অধিকার থাকবে না এ আইন কার্যকর হলে। একই সাথে হয়রানি আর নিপীড়নের শিকার হবেন সাংবাদিকেরা। তাই সার্বিক বিচারে এটা একটি নিকৃষ্ট আইন। আমরা এ আইন প্রত্যাখ্যান করছি। বাতিলের দাবি করছি। সাংবাদিক সমাজ এ আইন মানবে না।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের এক অংশের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল নয়া দিগন্তকে বলেন, আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা কিন্তু ৩২ ধারায় যা রয়েছে তাতে এ দু’টি ধারা পরস্পরবিরোধী। ৩২ ধারায় যা বলা হয়েছে তাতে স্বাধীন সাংবাদিকতা রইল কোথায়?
তিনি বলেন, আমারা যেসব মত দিয়েছিলাম তা প্রতিফলিত হয়নি পাস হওয়া আইনে। আমরা সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা বলেছিলাম। তাও রাখা হয়নি। অপরদিকে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে কাউকে গ্রেফতার করার।
গত বছরের শুরু থেকে বিতর্ক সমালোচনা চলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে। বছরের মাঝামাঝি এ বিতর্ক আর সমালোচনা তীব্র আকার ধারণ করে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় একের পর এক সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে নেয়া হয় আদালতে। শুধু তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশের জন্য নয় ফেসবুকে অন্যের মন্তব্যে শেয়ার করার অভিযোগেও মামলা এবং গ্রেফতার ঘটনা ঘটে সারা দেশে। এসব ঘটনায় উদ্বেগ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বমহলে। শুধু প্রচলিত সংবাদমাধ্যম নয়, ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৫৭ ধারাকে। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে সাংবাদিক সমাজ। তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সংশোধন করে নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। সেখানে ৫৭ ধারা নিয়ে উদ্বেগের অবসান ঘটানো হবে। কিন্তু ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বিষয়ে তখন যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ভিন্ন নাম দিয়ে ৫৭ ধারাকে বহাল রাখা হচ্ছে মাত্র। গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন হলে তাতে দেখা যায় ৫৭ ধারা নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল তা আগের মতোই বহাল রাখা হয়েছে ভিন্ন নামে। ফলে তখন থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আপত্তি চলতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের আপত্তি উপেক্ষা করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস হলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের মতে, ৫৭ ধারার বিতর্কিত বিষয়গুলোকেই নতুন আইনে কয়েকটি ধারায় তথা ২৮, ২৯, ৩১ এবং ৩২ ধারায় ভাগ করে রাখা হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ বিভিন্ন সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে ডিজিটাল আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায়।
কোনো কোনো সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অংশ আগের আইনের ৫৭ ধারার চেয়েও জঘন্য। বিশেষ করে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করার মাধ্যমে ৫৭ ধারাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাতিল হওয়া তথ্য ও যোগোযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ছিল (এক) কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (দুই) কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ুণœœ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এ েেত্র পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করায় কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড হতে পারে।
এ ছাড়া রয়েছে সবচেয়ে আপত্তিকর ৩২ ধারা যা এ প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement