২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জোটগতভাবে আন্দোলন ও নির্বাচন করবে ঐক্যপ্রক্রিয়া

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শুরু আজ : ড. কামাল হোসেন
যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন ড. কামাল হোসেন : নয়া দিগন্ত -

জোটগতভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫ দফা দাবি এবং ৯টি লক্ষ্য ঘোষণা অনুষ্ঠানে ঐক্য প্রক্রিয়ার সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের শুরু আজ। তিনি বলেন, জনগণ যেন তাদের মালিকানা ফিরে পায় সে ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে হবে। জনগণ যে আন্দোলনে আছে, তা এখন স্পষ্ট। তাই জনগণের বিজয় নিশ্চিত।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া হয়। দুই জোটের পক্ষ এ ঘোষণা পড়ে শোনান নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। এ সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা: জাফর উল্ল্যাহসহ গণফোরাম নেতাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিক উল্লাহ, মোশতাক আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, জেএসডি নেতাদের মধ্যে আবদুল মালেক রতন, তানিয়া রব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে এ ঘোষণা পাঠ করার আগে দুই জোটের পক্ষ থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দৌজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বেলা ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে তারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে গিয়ে ওই ঘোষণা দেয়া কথা ছিল। তবে বদরুদ্দৌজা অনুষ্ঠানে আসার আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে পৌঁছতে পারেননি। পরে বিকেল ৪টায় ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে রওনা দেয়। কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে কয়েক গজ হেঁটে একটি প্রাইভেট কারের ওপরে দাঁড়িয়ে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের শহীদ মিনারে যেতে দেয়ার অনুমতি দেয়নি। তাই তারা আবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ফিরে আসেন। রব এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিচার জাতি করবে। আগামী ফেব্রুয়ারির আগেই যে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদায় নেয় সে জন্য দোয়া করেন তিনি। তিনি বলেন, জুলুমের অবসান হবেই। এর পর নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না পাঁচ দফা ও ৯টি লক্ষ্য পড়ে শোনান।
ঘোষণার পরপরই ড. কামাল হোসেন বলেন, এই দেশের মালিক জনগণ। দেশের মালিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে দেশ রক্ষা পাবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, কালো টাকার প্রভাবমুক্ত হবে দেশ। রাষ্ট্র-সমাজ আগ্রাসন থেকে মুক্ত হবে। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিরা দেশের মালিকদের ভোটে নির্বাচিত হবে। তিনি বলেন, কার্যকর গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনে ভেজাল হলে জনগণ আর দেশের মালিক থাকে না। আর তিন বছর পর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে উল্লেখ করে ড. কামাল বলেন, আমরা এ তিন বছরের মধ্যে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও দেশের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করব। মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করব। ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনব।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাঁচ দফায় বলা হয়েছে, এক, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। দুই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। তিন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা যাবে না। চার, নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। একই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। পাঁচ, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে, যুগোপযোগী সংশোধনের মাধ্যমে ‘গণ প্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ গণমুখী করতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৯টি লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- এক, দেশে স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ এবং এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের লক্ষ্যে সংসদ, সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকর করা। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ কমিশন গঠন করা। দুই, দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে কঠোর হাতে দমন এবং ইতঃপূর্বে দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। তিন, দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে উন্নয়নে মেধাকে একমাত্র যোগত্যা হিসেবে বিবেচনা করা। চার, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা। পাঁচ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণের কালো থাবা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স^চ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কাঠামোগত সংস্কার সাধন। ছয়, রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, জনগণের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা, জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত। সাত, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল ও কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। আট, ‘সব দেশের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়’- এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক সৎপ্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসায় বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ। নয়, বিশ্বের সব নিপিড়ীত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত ও পুনর্বাসনের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার। দেশের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করে তোলা।


আরো সংবাদ



premium cement