২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইন্দোনেশিয়া : স্বপ্ন পূরণে প্রেসিডেন্ট ও জনগণ যেখানে এক কাতারে

১৮তম এশিয়ান গেমস উদ্বোধনের পর দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো -

ধাক্কাটা তখনই লাগল যখন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এশিয়ান অলিম্পিক অর্গানাইজেশনের কাছে প্রস্তাব রাখলেন ২০৩২ সালে অলিম্পিকের আয়োজক হওয়ার। ১৯৬২ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়ান গেমসের আয়োজক হয়েই লক্ষ্য স্থির করেছেন অলিম্পিকের। কি সুদূরপ্রসারি ভাবনা!
প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাবের ১২ ঘণ্টাও পেরোয়নি। সেই দেশের জনগণ যেন ধরেই নিয়েছে ১৪ বছর পর তাদের দেশেই হবে অলিম্পিক। যাকে জিজ্ঞেস করবেন তিনিই বলবেন আমাদের প্রেসিডেন্ট যখন বলেছেন তখন তাকে সহযোগিতা করা প্রতিটি ইন্দোনেশিয়ানের কর্তব্য। তাদের ক্রীড়ামন্ত্রী এবং এশিয়ান গেমস অর্গানাইজিং কমিটির চেয়ারম্যান এরিক থোহির জানিয়েছেন, আগামী ১০ বছরে আমরা বহু উন্নত দেশকে টেক্কা দেবো। অলিম্পিক কাউন্সিল আমাদের উন্নতি দেখেই রাজি হবে আমরা যাতে অলিম্পিকের আয়োজক হই। এশিয়ান গেমসের সফল কার্যক্রম অবশ্যই তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বাধ্য করবে।
এশিয়ান গেমসের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট উইদোদো যখন মোটরসাইকেল নিয়ে প্রবেশ করলেন গেলোরা বাঙ কার্নো মেইন স্টেডিয়ামে তখন তাকে মনে হয়েছে সিনেমার স্ট্যান্টমাস্টার। আবার যখন উশু প্রতিযোগিতায় গেলেন পুরস্কার দিতে তখন তাকে মনে হয়েছে উশুর কোনো বড় গ্র্যান্ডমাস্টার। সমাপনী দিনে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি জেবিকে স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকলেও হাইলাইটের আশায় না থেকে তিনি চলে গিয়েছিলেন ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত লম্বক প্রদেশে। অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের সাথে সময় কাটিয়েছেন। তখন তাকে মনে হয়েছে সমব্যাথী। সমাপনীর আলোকরশ্মির চেয়ে লম্বকে থাকাটাই যেন শ্রেষ্ঠ রশ্মি মনে করেছেন প্রেসিডেন্ট উইদোদো। এমন ব্যক্তিকে ভালো না বেসে উপায় কি। ইন্দোনেশিয়ার জনগণ হয়তো সে কারণেই যতবারই স্ক্রিনে প্রেসিডেন্টের ছবি দেখানো হয়েছে ততবারই চেয়ার ছেড়ে উঠে স্বাগত জানিয়েছেন তাকে। একজন প্রেসিডেন্ট কতটা জনপ্রিয় হলে এমনটা হতে পারে, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এক কথায় বলা চলে অবিশ্বাস্য।
তবে দেশটির জনগণের মাঝে যে দেশপ্রেম রয়েছে তা ছাড়িয়ে যায় প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ডকেও। জাকার্তার সাতিয়াবুদিতে অওদা গেস্ট হাউজে ১৮ দিনে স্থানীয় অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দৃষ্টি কেড়েছে সেটি হচ্ছে যে যার মতো কাজ করছে। গভীর রাতে যার যার দোকান বন্ধ করার পর সামনের জায়গা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ভুলেও পাশে থাকা ড্রেনে ময়লা ফেলছে না। আগ্রহ নিয়ে এক বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম, তোমাদের এখানে ধর্ষণ, খুন, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা কি হয় না। বন্ধুটি কোনো রকম সঙ্কোচ না করে বললÑ হয়। তবে খুবই কম। আর এশিয়ান গেমসের সময় সেটি শূন্য পর্যায়ে। কারণ এখানে ৪৫-৪৬টি বিদেশী দল অংশ নিয়েছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে ইন্দোনেশিয়ার বদনাম হবে। তাই সবাই দেশের সুনামের স্বার্থে সংযত।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন নিয়ে অন্তত দুই চার কথা বলতেই হয়। সে দিন গেস্ট হাউজের পাশে একটি মসজিদে কোরবানি দেয়া হলো। মসজিদ কমিটি আসর নামাজের আগে লাইনে অপেক্ষমাণ সবাইকে সমপরিমাণ গোশতের পুঁটলি (প্রায় তিন কেজি) দিলেন। এটি ভালো লাগলেও মুসলিম প্রধান দেশে ঈদুল আজহার ছুটি মাত্র এক দিন থাকায় ব্যাপারটি কেমন যেন অস্বস্তিকর মনে হলো। তবে ঈদুল ফিতরে নাকি তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের নামাজ পড়লাম দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ মসজিদ ইশতিকলালে। সকাল সাড়ে ৭টায় জামাত। ঠিক সময়েই শুরু হলো। অপেক্ষা করা হলো না প্রেসিডেন্ট কিংবা কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকদের ধারণা বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে ইন্দোনেশিয়া অর্থনৈতিকভাবে আগামী ২০ বছরের মধ্যে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সমকক্ষ হয়ে উঠবে। ইন্দোনেশিয়ার বিকাশমান অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো অর্থ লগ্নি করতে কোনোরকম দ্বিধা করছে না। আমেরিকার বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জর্জ ফ্রেডম্যানের মতে, বিনিয়োগ আত্মীকরণে সমস্যাগ্রস্ত ফিলিস্তিন ও অন্যান্য দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ইন্দোনেশিয়া একটি স্থিতিশীল ভিত্তি। অন্যান্য দেশে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ নেই এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির যথেষ্ট অবকাশ নেই। সে সুযোগটি লুফে নিতে পারে ইন্দোনেশিয়া। আর এ কারণেই হয়তো অলিম্পিকের মতো বড় আয়োজনে চোখ তাদের।
পাবলিক সেক্টর অ্যান্ড সভরেইন ওয়েলথ ফান্ড সংক্রান্ত সিটি গ্রুপ গ্লোবাল প্রধান জুবাইদ আহমদ ফ্রেডম্যানের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, আমি বিশ্বাস করি ইন্দোনেশিয়া তাদের প্রবৃদ্ধির হার আগামী ২০ বছর পর্যন্ত ৬.৭৫ শতাংশ অব্যাহত রাখতে পারে। ২০০৮ সালে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ছিল প্রায় চার হাজার ডলার। জাতীয় উৎপাদনে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে ১৩ দশমিক পাঁচ, ৪৫ দশমিক ছয় ও ৪০ দশমিক আট শতাংশ। জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান তৃতীয় হলেও ৪২ শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষিতে নিয়োজিত। বর্তমানে এ পরিসংখ্যান আরো ঊর্ধ্বগামী।
ইন্দোনেশিয়ার জনগণের বিশ্বাস জনতার সাথে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারাটাই যোগ্যতার পরিচয়। প্রেসিডেন্ট নিজেকে সাধারণ মানুষ বলেই গণ্য করেন। কোনো জায়গায় যেতে আসতে তার বিশেষ প্রটোকলের প্রয়োজন পড়ে না। যতটুকু না হলেই নয় ঠিক ততটুকুই চান তিনি। ইন্দোনেশিয়ার সাথে বাংলাদেশের অনেক মিল। ২০০০ সালেও ইন্দোনেশিয়া বলতে বুঝা যেত গরিব রাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে তাদের অবস্থান ছিল শীর্ষে। সে ধারা পেরিয়ে তারা এখন নিজেরা উন্নত হতে শিখেছে। রাষ্ট্রের পরিকল্পনা তাদের পৌঁছে দিচ্ছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। পাশাপাশি আমাদের নিঃশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement