২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাখাইনে গণহত্যার দলিল সংগ্রহে রোহিঙ্গারা

-

২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রণয়ন করেছেন একদল রোহিঙ্গা। ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তার আওতায় তালিকা প্রণয়ন করেছেন তারা। তালিকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রয়টার্স।
‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ বলছে, হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি, পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে অনেকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি তারা। তালিকাটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মিয়ানমারের মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে প্রণীত ওই হত্যাযজ্ঞের তালিকা কাজে আসবে। তবে প্রণীত তালিকা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস নামে পরিচিত ত্রাণ সংস্থা মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স বর্তমানে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে। তারা জানায় আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার শুরুতেই ছয় হাজার ৭০০ জনকে হত্যা করা হয়েছে; কিন্তু এরপর আর কোনো সংখ্যা জানা যায়নি। জানা যায়নি কারো পরিচয়ও। এবার ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ ব্যানারে রোহিঙ্গাদের নিজেদের প্রণীত তালিকায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তালিকা প্রণয়নকারীরা জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। তাদের প্রত্যেকের নাম, বয়স, বাবার নাম, ঠিকানা ও কিভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই বিস্তারিতও তুলে ধরা হয়েছে তালিকাটিতে। তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে ২০১৬ সালের অক্টোবরে সহিংসতায় নিহত রোহিঙ্গারাও।
‘আমি যখন শরণার্থী হয়ে গেলাম, তখন থেকেই কিছু করার তাড়না অনুভব করতে থাকি।’ জানান ৪৩ বছর বয়সী মহিবুল্লাহ। তিনি বিশ্বাস করেন, তার তৈরি এই তালিকাটি ঐতিহাসিক তালিকা হয়ে থাকবে। নাহলে সবাই এর কথা ভুলে যাবে। রয়টার্স এই তালিকা নিয়ে মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কেউ ফোন ধরেনি। গত বছরের শেষদিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী থেকে দাবি করা হয়, নিরাপত্তাবাহিনীর ১৩ সদস্য নিহত হয়েছিলেন এবং ৩৭৬ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর লাশ উদ্ধার করেছে তারা। তাদের দাবি, ৫ সেপ্টেম্বর সামরিক অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
কোমরে বাঁধার ঐতিহ্যবাহী বার্মিজ বেল্ট ক্ল্যাড ইন লঙ্গিস পরে একদল রোহিঙ্গাই ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ ব্যানারে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছেন। তালিকা প্রণয়নকারীরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে যে, রোহিঙ্গারা বিশ্বের সমর্থন পেতে হত্যাযজ্ঞের কথা বানিয়ে বলেছে সে সম্পর্কে অবগত রয়েছে তারা। কিন্তু তারা জোরালোভাবে দাবি করেছে যে, তালিকা করার সময় তারা খুবই সাবধান ছিলেন, সবার নাম তোলা সম্ভব হয়নি। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। আগে ত্রাণকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মহিবুল্লাহ বলেন, ‘মংডু জেলার তুলাতোলি গ্রাম থেকে যারা পালিয়ে এসেছেন তারা সবাই বলেছেন নিহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। কিন্তু আমরা নাম পেয়েছি ৭৫০ জনের। তাই ৭৫০ জনই নিহত লিখেছি।’ তিনি জানান, ‘আমরা প্রত্যেক পরিবারে গিয়েছি, প্রত্যেকের নাম ধরে ধরে কথা বলেছি, তথ্য নিয়েছি। হামলার শিকার পরিবার থেকেই সবচেয়ে বেশি তথ্য পেয়েছি আমরা। কিছু তথ্য পেয়েছি প্রতিবেশী থেকে। কোনো আত্মীয় না পেলে আমরা পাশের গ্রামের মানুষের কাছ থেকে তথ্য নেয়ার চেষ্টা করেছি।’
এই তালিকা তৈরি করা রোহিঙ্গারা আগে কেউ ছিলেন ত্রাণকর্মী, কেউ শিক্ষক, কেউ বা ধর্মীয় নেতা। এখন শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়ার পর এ কাজটিই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন তারা। কারণ সরকারি সহায়তা ছাড়া কোনো বিদেশী সংস্থাই রাখাইনে যেতে পারছে না। কিয়াক পান দু গ্রামের সাবেক প্রশাসক মোহাম্মদ রাফি নামে এক রোহিঙ্গাও এই তালিকা তৈরিতে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের গোষ্ঠীর মানুষেরা অশিক্ষিত। সাক্ষাৎকারের সময় অনেকই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এরপরও যা তথ্য পেয়েছি তা খুবই বিশ্বাসযোগ্য।’
শরণার্থী ক্যাম্পের সঙ্কীর্ণ গলিতে বসে পুরোচিত্র তৈরি করা অনেক কঠিন। অনেক মানুষ একসাথে জড়ো হয়ে নিজেদের মতামত দিতে থাকেন। কখনো বৃষ্টির কারণে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। আজান দিলেও সবাই নামাজের জন্য চলে যায়। আবার একসাথে হলে সামান্য তারিখ নিয়েও বিবাদ লেগে যায়। জানা যায়, নভেম্বরে একদিন জুমার নামাজের পরে এই প্রকল্পের বিষয়টি সবার মাথায় আসে। তখনই পরিকল্পনা করা হয় এবং কয়েক মাস ধরে এই তালিকা তৈরির কাজ চলে।
এই প্রকল্পতেও অনেক ত্রুটি আছে। হাতে লেখা এই তালিকাটি একত্র করেছে স্বেচ্ছাসেবীরা। ফটোকপি করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেকের কাছে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি রোহিঙ্গাদের সাথে বার্মিজ ভাষায় কথা বলে। তাদের নামও বার্মিজ। তবে সব তথ্য রেকর্ড করা হয় ইংরেজিতে। এ জন্য বেশ জটিলতায় পড়তে হয় তাদের। যেমন তুলাতোলি গ্রামের নামই ৩০টি বানানে লেখা হয়েছে। তালিকাটি সংরক্ষণ করা হচ্ছিল একটি ক্লি¬নিকের পেছনের ঘরের এক শেল্ফে। রয়টার্সও এই তালিকা পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয় এটি। তারা জানায়, ২০১৬ সালের অক্টোবরের সহিংসতায় নিহতদের মাধ্যমে এই তালিকার শুরু বলা হলেও ২০১৫ ও ২০১২ সালের সহিংসতায় নিহত বেশ কয়েকজনের নাম আছে এতে। তালিকার বেশির ভাগ অংশ ইউরোপীয় প্রক্রিয়ায় লিপিবদ্ধ হলেও (প্রথমে দিন ও পরে মাস) কয়েকটি ছিল আমেরিকান প্রক্রিয়াতেও। তাই কিছু ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে না যে, আসলে ৯ মে লেখা হয়েছে নাকি ৫ সেপ্টেম্বর। তালিকার কতগুলো ভার্সন রয়েছে সেটাও স্পষ্ট নয়। কারণ রয়টার্সের কাছে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময়ই অনেক রোহিঙ্গা শার্টের পকেট কিংবা লুঙির ভাঁজ থেকে ছোট তালিকা বের করে দিয়েছেন। তালিকা তৈরি করা রোহিঙ্গারা বলেন, তারা প্রাপ্ত তথ্যের সারাংশ উপস্থাপন করেছেন। জাতিসঙ্ঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনসহ বিদেশী প্রতিনিধিদলের কাছে প্রত্যাবাসনের দাবিও জানানো হয়েছে।
তালিকা তৈরি করা রোহিঙ্গারা দিন দিন আরো বেশি সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। তারা তিনটি কুঁড়েঘরে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন এবং বৈঠক করেছেন। ভেতরে রেখেছেন টেবিল, প্লাস্টিক চেয়ার, ল্যাপটপ ও গ্রুপের নামসংবলিত একটি বড় ব্যানার। যেন নিজেদের অফিসই তৈরি করে ফেলেছেন। এমএসএফের করা জরিপে আসলে জোর দেয়া হয়েছিলে যে, কতজনের চিকিৎসাসুবিধা প্রয়োজন। তাই কতজন নিহত হয়েছেন সেটা স্পষ্ট ছিল না। রোহিঙ্গাদের করা তালিকার মতো এত বিস্তারিতও উল্লেখ ছিল না সেটাতে। মহিবুল্লাহ ও তার বন্ধুরা আশা প্রকাশ করেন, তাদের তৈরি করা তালিকা মিয়ানমারের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও মিয়ানমারের বিচারের সময় কাজে লাগবে তালিকাটি। কোনো কোনো রোহিঙ্গার আশা, হয়তো এই তালিকার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারকে বিচারের আওতায় নেয়া যাবে আর সেখানে থাকা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে তাদের। মোহাম্মদ জুবায়ের নামে তালিকা প্রস্তুতকারী এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমি যদি এখানে বেশি দিন থাকি তবে আমার সন্তানেরা জিন্স পড়তে শুরু করবে। কিন্তু আমি চাই তারা লুঙ্গি পরুক। আমি আমার সংস্কৃতি হারাতে চাই না। আমরা এই নথিপত্র জাতিসঙ্ঘকে দিতে চাই। আমরা বিচার চাই যেন আমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারি।’
ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দুর্যোগ পরামর্শক ম্যাট ওয়েলস বলেন, তিনি আফ্রিকান দেশগুলোতে শরণার্থীদের এমন তালিকা তৈরি করতে দেখেছন। তবে রোহিঙ্গাদের তৈরি তালিকাটি আরো কাঠামোবদ্ধ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এতে এটাই স্পষ্ট হয় যে, মূলত পুরো গোষ্ঠীই এখন একটি স্থানে আটকা পরে গেছে।’ ওয়েলস বিশ্বাস করেন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে এই তালিকা খুবই কাজে আসবে। তিনি বলেন, ‘যেই গ্রামগুলোতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সাক্ষীসহ তার বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ রয়েছে তালিকাটিতে।’
রাখাইনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরও। সেই রিপোর্টও বিচারের কাজে আসতে পারে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে তাদের করা তালিকাটি মূলত এমএসএফের প্রক্রিয়াতেই তৈরি করা। রোহিঙ্গা তালিকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি এমএসএফও। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারাও বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তারা শুধু সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, যেকোনো সংগঠনের তৈরি করা তালিকাই বিচারিক কাজে ব্যবহার করা যাবে কি না। এ দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রেজিস্ট্রি ও প্রসিকিউটর অফিসের থমুখপাত্ররা এই তালিকা নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।
তুলতোলির একজন দোকানদার মোহাম্মদ সুলেমান বলেন, তাদের তৈরি করা এই তালিকা তার পাঁচ বছরের মেয়ের জন্য পূর্বসূরিদের ইতিহাস হয়ে থাকবে। এরপরই তিনি ভেঙে পড়েন। কান্নারত অবস্থায় তিনি বিবরণ হাজির করেন, কিভাবে প্রতিদিন তার মেয়ে মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে। বাকি চার মেয়ের সাথে তার স্ত্রীকেও খুন হতে হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। সুলেমান বলেন, একদিন সে বড় হবে, শিক্ষিত হবে। তখন হয়তো জানতে চাইবে কী হয়েছিল, কখন হয়েছিল। আমি হয়তো তখন থাকব না। কিন্তু এই লিখিত নথিটি যদি নিরাপদে থাকে ও জানতে পারবে ওর পরিবারের সাথে কী হয়েছিল।’


আরো সংবাদ



premium cement
আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে মারামারি, মাঠ ছেড়ে উঠে গেল সাদা-কালোরা কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেভাবেই ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে : কৃষিমন্ত্রী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সিএনজি ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪ ভান্ডারিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে দর্শনার্থীদের ঢল তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল